কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় মাওবাদী হামলার পর থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রে তিনি। এই হামলা নিছক মাওবাদীদের না কি তার পিছনে আরও গভীর কোনও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিজেপি সরাসরি অভিযোগ করেছে, এর পিছনে রয়েছে কংগ্রেস নেতা, ছত্তীসগঢ়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজিত জোগীর হাত। এমনকী, ওই যাত্রায় জোগী রুট বদল করিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে ইতিমধ্যেই।
কেন গোটা ঘটনায় বার বার তাঁর ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ উঠছে?
এর পুরোটাই ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন অজিত জোগী। তাঁর বক্তব্য, ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় রাজ্য সরকার যথাযথ সুরক্ষা দিতে না পারাতেই এই নৃশংস ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এখন নিজেদের দায় এড়াতে রাজ্য সরকার
ও বিজেপি সুকৌশলে এই সব অভিযোগ তুলছে। তাঁর কথায়: “তদন্তে সবই বেরোবে।”
এত দিন ঘুরিয়ে অভিযোগ আনলেও মধ্যপ্রদেশ রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি নরেন্দ্র সিংহ টোমার এ বার সরাসরি অভিযোগ এনেছেন জোগীর বিরুদ্ধে। রাজ্য বিজেপি-র কার্যকরী সমিতির বৈঠকে টোমার সরাসরি এই অভিযোগ আনার পরেই তাঁর বিরুদ্ধে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন জোগী। বলেছেন, ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা না চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা রুজু করা হবে।
রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন আর মাত্র মাস পাঁচেক পরে। ঠিক এই সময়ে ছত্তীসগঢ় রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি নন্দকুমার পটেল, বস্তারের কংগ্রেস নেতা মহেন্দ্র কর্মা, প্রাক্তন বিধায়ক উদয় মুদালিয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যা করেছে মাওবাদীরা। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল-সহ বেশ কয়েক জন নেতা এমন ভাবে জখম হয়েছেন যে, বেশ কিছু দিনের মধ্যে তাঁরা আগের মতো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারবেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই অবস্থায় এ হেন অভিযোগে যে যথেষ্ট বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছেন জোগী তা তাঁর কথা থেকেও স্পষ্ট।
আনন্দবাজারের সঙ্গে কথোপকথনে জোগী বললেন, “অনেক আগে থেকেই জানা ছিল যে আমি হেলিকপ্টারে সুকমায় যাব এবং হেলিকপ্টারেই সেখান থেকে রায়পুরে ফিরব। এটা আমার দলীয় নেতারা যেমন জানতেন, তেমনই প্রশাসনেরও জানা ছিল। কারণ, দুর্ঘটনায় শিরদাঁড়ায় ভয়ঙ্কর চোটের জন্য আমি এক থেকে দেড়শো কিলোমিটারের বেশি গাড়িতে চড়তে পারি না। তা-ও থেমে থেমে। তা ছাড়া আমার হুইলচেয়ার রয়েছে। সেটা সব গাড়িতে তোলাও যাবে না।” জোগীর কথায়, “কাজেই আমি দলীয় নেতা-কর্মীদের বিপদের মুখে ঠেলে সড়কপথে না গিয়ে হেলিকপ্টারে কেন ফিরলাম, সে প্রশ্নও ওঠে না।”
গত ২৫ মে শেষ মুহূর্তে ‘পরিবর্তন যাত্রা’র রুট বদলের যে অভিযোগ উঠেছে সে প্রসঙ্গে জোগীর বক্তব্য: “এটা হাস্যকর অভিযোগ। কারণ, এই গোটা যাত্রার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন প্রদেশ সভাপতি নন্দকুমার পটেল, সরগুজার কংগ্রেস বিধায়ক টি এস সিংহদেও। এ ছাড়া, যখন যে জায়গায় যাত্রা হবে, সেখানকার সংশ্লিষ্ট বিধায়ক বা সাংসদ এই বিষয়টি ঠিক করেন। তাঁরা কেউই রুট বদল করেননি। করার কথাও নয়। কারণ, ওই রুটটাই সংক্ষিপ্ততম। এখানে আমার ভূমিকা কোথায়?”
বরং, ওই দিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে কার্যত ছিলই না, তা সুকমার সভার ভিডিও দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন জোগী। তাঁর কথায়: “সে দিনের সভার আর নেতাদের কনভয়ের ছবিটা দেখে বলুন, পুলিশি ব্যবস্থা বলতে আদপে কী ছিল?” বরং তাঁর ক্ষোভ: “আমি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। আমার নিরাপত্তার বহরটা শুনবেন? সুকমায় হেলিপ্যাড হয়েছিল শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে। চার দিকে জঙ্গল। পাইলট প্রথমে সেখানে নামতেই চাননি আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে। কোনও নিরাপত্তাকর্মীর উপস্থিতি উপর থেকে চোখেই পড়েনি।”
বিষয়টি বুঝতে পেরে শেষমেশ কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জঙ্গলের কাঠ আর ঘাসপাতা এনে হেলিপ্যাডের ধারে জ্বালিয়ে দেন, যাতে দূর থেকে ধোঁয়া দেখে পুলিশ সেখানে পৌঁছয়। জোগীর অভিযোগ, এতেও হয়নি। শেষে দলের কর্মীরা সভাস্থল থেকে কয়েক জন পুলিশকে ডেকে আনেন হেলিপ্যাডে। আকাশে বেশ কিছু ক্ষণ চক্কর কেটে তার পরে হেলিকপ্টার নামে। জোগীর বক্তব্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী (পিএসও) ছাড়া সে দিন কার্যত পুলিশি ব্যবস্থাই ছিল না। ভিডিও, ছবি-সহ এ সব তথ্যপ্রমাণও তাঁরা তদন্তের সময় পেশ করবেন।
তা হলে এই অবস্থায় রাজ্য কংগ্রেসের হাল ধরবেন কে? এআইসিসি-র পক্ষ থেকে এখনও কোনও নাম ঘোষণা হয়নি। বস্তুত, আগামী ৫ জুনের আগে তার সম্ভাবনাও কম। কারণ, নিহত নেতা-কর্মীদের পারলৌকিক ও সংশ্লিষ্ট নানা কাজকর্ম তার আগে মিটবে না। সঙ্গত কারণেই তার আগে এই ঘোষণা করবে না কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। অন্তত এমনটাই মনে করছে দলীয় মহল।
রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি পদে অজিত জোগী ছাড়াও বেশ কয়েকটি নাম ভাসছে। যেমন, কেন্দ্রীয় কৃষি প্রতিমন্ত্রী চরণদাস মহন্ত, স্থানীয় কংগ্রেস নেতা ভূপেশ বাগেল, সত্যনারায়ণ শর্মা, আদিবাসী নেতা রামপুকার সিংহ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহম্মদ আকবর প্রমুখ। দৌড়ে চরণদাস মহন্ত এগিয়ে থাকলেও দলের অনেকেই মনে করেন, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা খুব বেশি নয়। কংগ্রেস রাজনীতির হাল-হকিকত সম্পর্কে খবর রাখা অনেকের মতে, ফের শিকে ছিঁড়তে পারে অজিত জোগীর।
কারণ, মাত্র মাস পাঁচেকের মধ্যে কংগ্রেসকে ঠেলে তোলা জোগী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁকে আনলে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জোগী নিজে এ ব্যাপারে কী বলেছেন?
তাঁর কথায়: “যিনিই রাজ্যে দলীয় প্রধান হোন, এত কম সময়ের মধ্যে দলকে চাঙ্গা করাটা মোটেই সহজ কাজ নয়। তা ছাড়া, তাঁকে বস্তারে আবার যেতেই হবে। না গেলে দলের নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হবেন না।” ঘনিষ্ঠ মহলে জোগী অবশ্য বলেছেন, তিনি নিজে ৯০ শতাংশ হলে রাজ্যের বাদবাকি নেতারা মিলে ১০ শতাংশ।
তিনি নিজে রাজ্য কংগ্রেসের প্রধান হতে চান কি চান না?
সরাসরি উত্তর জানতে চাইলে মুচকি হেসে জোগীর মন্তব্য: “আমি সনিয়া গাঁধী ও রাহুল গাঁধীর আজ্ঞাই পালন করব। আই উইল ওবে।”
|