অর্থনীতির প্রথম পাঠই বলে, জোগান কমলে দাম বাড়ে। এ দেশে সোনা কি তার ব্যতিক্রম হল?
দেশে ডলার যত আসছে, বেরিয়ে যাচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি। এই সমস্যার দাওয়াই হিসেবে সোনা আমদানিতে রাশ টেনেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। জানিয়ে দিয়েছে, রফতানির জন্য গয়না তৈরি ছাড়া বিদেশ থেকে সোনা আনতে পারবে না বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি। ফলে সোনার জোগান কমছে বাজারে। কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম বাড়ার লক্ষণ চোখে পড়েনি এখনও। ফলে, স্বাভাবিক ভাবেই ধন্দে সাধারণ মানুষ। আগামী দিনে দর আরও পড়বে কি না, তা-ও ঠাহর করতে পারছেন না তাঁরা।
গয়না শিল্প অবশ্য স্পষ্ট জানাচ্ছে, মাঝে-মধ্যে দর একটু-আধটু বাড়লেও, মাস তিনেক আগে চাকা ঘোরার সম্ভাবনা কম। তাঁদের মতে, এই মুহূর্তে দামী ধাতুটির বাজার চূড়ান্ত অনিশ্চিত। এবং এখনও বেশ কিছু দিন তার দাম তলানিতে থাকারই সম্ভাবনা। অনেকের ধারণা, মাস তিনেকের মধ্যে প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দর ২৩ হাজারে নেমে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সোনার বাজারের বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিয়ের মরসুমের বাড়তি চাহিদা কিংবা দেশে জোগান কমলে, দরের সামান্য হেরফের হতে পারে ঠিকই। কিন্তু ভারতে সোনার দর আসলে নির্ভর করে বিশ্ব বাজারে তার দামের উপর। যেহেতু সেখানেই সোনার দশা এখন নড়বড়ে, তাই এ দেশেও এখনই তার বরাত ফেরা শক্ত।
কিন্তু গত ১২ বছর টানা যার দাম বেড়েছে, বিশ্ব বাজারে সেই সোনার এমন বেহাল দশা কেন? কেন অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আগামী দিনে আউন্সে তার দর গিয়ে ঠেকবে ১১৪৫-১২০০ ডলারে (এখন ১৩৮০ ডলারের আশেপাশে)?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মূল কারণগুলি হল
• ২০০৮ সালে লেম্যান ব্রাদার্সের পতনের পর মন্দার বছরগুলিতে সারা বিশ্বেই শেয়ার বাজারের অবস্থা ছিল করুণ। লগ্নিকারীরা ভরসা রাখতে পারছিলেন না ডলারের উপরেও। তাই বিনিয়োগ সরে এসেছিল সোনায়। চড়চড়িয়ে বেড়েছিল দামও। কিন্তু এখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে মার্কিন অর্থনীতি। আশঙ্কার মেঘ কিছুটা ফিকে হয়েছে ইউরোপেও। যার দৌলতে সামান্য হলেও প্রাণ ফিরেছে বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজারে। চাঙ্গা হয়েছে ডলার। তাই লাভের আশায় এ বার সোনা থেকে সরিয়ে সেখানে টাকা ঢালছেন লগ্নিকারীরা।
• সম্প্রতি দেনার দায় মেটাতে ভাঁড়ারের সোনা বিক্রির পরিকল্পনা জানিয়েছিল ইউরোপের কয়েকটি দেশ। এর ফলে বিশ্ব বাজারে সোনার জোগান এক ধাক্কায় অনেকখানি বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছিলেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য জানাচ্ছেন, জোগান বৃদ্ধির এই আশঙ্কাকে কিছুটা সত্যি করে ইতিমধ্যেই মজুত সোনার সিংহভাগ বিক্রি করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের বেশ কয়েকটি বাঘা লগ্নিকারী সংস্থা। অল ইন্ডিয়া জেম অ্যান্ড জুয়েলারি ট্রেড ফেডারেশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাছরাজ বামালুয়া বলেন, “আমেরিকায় ওয়ারেন বাফের সংস্থা এবং পলসন ব্রাদার্স তাদের মজুত সোনার প্রায় সবটাই বিক্রি করে দিয়েছে। টানা বিক্রি করে চলেছে ওই দেশেরই অগ্রণী গোল্ড ইটিএফ সংস্থা এসপিডিআর-ও। ফলে জোগান বাড়ছে বাজারে।”
• শেয়ার বা পণ্য লেনদেনের বাজারে লোকসানের সম্ভাবনা এড়াতে ‘হেজিং’ করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ হয়তো আগাম লেনদেনে ডলারে টাকা রাখার পাশাপাশি সোনাও কিনলেন। যাতে ডলার পড়লে, সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে সোনা। এত দিন লাগাতার দাম বাড়ার সময় ‘হেজিং’-এর জন্য সোনার চাহিদা ছিল চড়া। কিন্তু ফিনশোর ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেসের এমডি লক্ষ্মণ শ্রীনিবাসনের মতে, “এখন হেজিংয়েও সোনা চমক হারিয়েছে।” অর্থাৎ, ক্রমশ জোরালো হচ্ছে আগামী দিনে দাম আরও কমার আশঙ্কা। যার জেরে শুক্রবারও বিশ্ব বাজারে দর পড়েছে সোনার।
তা হলে কি আগামী দিনে এ দেশের বাজারে নীচের দিকেই থাকবে সোনার দাম? বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে এক আউন্স সোনা উৎপাদনের খরচ হাজার ডলারের কিছু বেশি। তাই বিশ্ব বাজারে তার দর ১১৪৫ ডলারের নীচে নামা শক্ত। কিন্তু এটুকু ছাড়া দরের পতনে ছেদ পড়ার তেমন লক্ষণ নেই। তার উপর এখন বিয়ের মরসুম প্রায় শেষ। আগামী তিন মাস বড় উৎসব নেই। তাই চাহিদার চাকায় চেপে দাম বাড়ার সম্ভাবনাও এই মুহূর্তে বেশ কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যুদ্ধ বাধলে বা ফের মন্দার মেঘ গাঢ় হলে অবশ্য অন্য কথা। |