কিছু কিছু মানুষ রয়েছে যারা প্রতিকূলতাকে জয় করে ছিনিয়ে নেয় সাফল্যকে। শুধু দারিদ্রের বিরুদ্ধেই লড়াই নয়, অন্য যে কোনও বাধাকে কাটিয়ে পৌঁছে যায় ইপ্সিত লক্ষ্যে। কৃষ্ণনগরের ভান্ডারছোলার বাসিন্দা সদ্য মাধ্যমিক পাশ করা বাপ্পা ঘোষ তাদেরই একজন।
সংসারে অভাব ছিলই। আবার পরীক্ষা চলাকালীন বাবাকে হারিয়েও মনের জোর হারায়নি বাপ্পা। এত কিছুর পরও অঙ্কে ১০০, জীবন বিজ্ঞানে ৯৮, ভৌতবিজ্ঞানে ৯২, ইংরাজিতে ৭৫, ইতিহাসে ৮০ আর ভূগোলে ৯৫। বাবা নরেশ ঘোষ ছিলেন রিক্সাচালক। সংসারে একমাত্র রোজগেরে। পরীক্ষার চার দিন আগে পথ-দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হন তিনি। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের বেডে শুরু হয় যমে-মানুষে টানাটানি। আর তারই মধ্যে মনকে নিজের বশে রেখে দিয়ে গেছে একটার পর একটা পরীক্ষা। কিন্তু অঙ্ক পরীক্ষার দিন কিছুতেই যেন মনটা নিজের বশে থাকছিল না। পরীক্ষা কেন্দ্রে বসে সব অঙ্কের সমাধান করতে করতে মনটা বার বার গুমড়ে উঠছিল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। দীর্ঘ লড়াই শেষে ওই দিনই যে মৃত্যু হয়েছিল নরেশ ঘোষের। বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে সোজা পরীক্ষা কেন্দ্রে বাপ্পা যখন পরীক্ষা দিচ্ছে তখন কৃষ্ণনগরের মর্গে চলছে নরেশবাবুর ময়না-তদন্ত।
পরীক্ষা শেষে বাবাকে নবদ্বীপের শ্মশানে দাহ করে গভীর রাতে বাড়ি ফেরা। পরদিন আবার জীবন বিজ্ঞান পরীক্ষা। কিন্তু কোনও কিছুই আগের মত দিতে পারেনি। বাপ্পার ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বোন পড়ে দশম শ্রেণিতে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় যে সংসারে সেখানে তিনজন ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে নরেশবাবুর স্ত্রী রূপালীদেবীর পক্ষে। বাপ্পা বলে, “অঙ্ক পরীক্ষার দিন ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য এ ছাড়া আমার দ্বিতীয় কোনও পথ ছিল না।” গ্রামেরই তিনজন গৃহশিক্ষক নামমাত্র টাকা নিয়ে বাপ্পাকে পড়াতেন। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে ডাক্তার হতে চায় বাপ্পা। কিন্তু তার জন্য যে অনেক খরচ! বাপ্পা বলে, “জানি। বাবার কাছ থেকে শেষ লড়াইটা তো জারি রাখি।” পানিনালা সত্যপ্রিয় রায় স্মৃতি শিক্ষা নিকেতনের সহকারি প্রধান শিক্ষক বিমলকৃষ্ণ পাল বলেন, “বাবা মারা না গেলে ছেলেটা আরও ভাল রেজাল্ট করত। ওর জন্য আমরা গর্বিত। আমরা সব রকম ভাবে ওর পাশে থাকব।” |