|
|
|
|
মানবিকতা নয়, আইনই সব, টের পাচ্ছেন যূথিকারা |
দীক্ষা ভুঁইয়া • কলকাতা |
রাজ্য সরকারের তৈরি তালিকায় তিনি নিখোঁজ। কিন্তু রেলের চিঠিতে মৃত।
রেলের সেই চিঠিও জ্ঞানেশ্বরী রেল দুর্ঘটনার শিকার প্রসেনজিৎ আটার ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করার ক্ষেত্রে কোনও কাজে আসেনি স্ত্রী যূথিকা দেবীর। স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে না পারায় গত তিন বছর ধরে স্বামীর বিমা ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের টাকা হাতে পাচ্ছেন না যূথিকা। রেলের প্রতিশ্রুত চাকরিও মিলছে না সার্টিফিকেটের অভাবেই।
যূথিকাদেবী একা নন। তাঁর মতো একই ধরনের সমস্যায় রয়েছেন নদিয়া তেহট্টের সোহনআরা বিবি, ছাপেত ফকির, ঘোলার শুক্লা রায়ের মতো বেশ কয়েকটি পরিবার। সোহনআরা বিবি তাঁর স্বামীর নামে কেনা জমি বিক্রি করতে পাচ্ছেন না ডেথ সার্টিফিকেটের অভাবেই। ব্যাঙ্ক-বিমা সংস্থার কর্তাদের সকলেরই এক বক্তব্য, মানবিকতা নয়, আইনই সব। |
|
রাজভবনে যূথিকা। |
কিন্তু ঘটনার পরে যারা চিঠি লিখে প্রসেনজিৎবাবুকে মৃত বলে জানিয়েছিল, সেই রেল কেন চাকরি দেয়নি যূথিকাকে? রেল বলছে, চিঠির বয়ানে ভুল হয়ে গিয়েছিল। রেলের খাতাতেও ওই ব্যক্তি নিখোঁজই। চাকরি পেতে হলে ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে। কিন্তু যূথিকার হাতে থাকা দক্ষিণ-পূর্ব রেলের চিঠিতে স্পষ্ট বলা আছে, স্বামী প্রসেনজিৎ আটার ‘মৃত্যু’-র জন্য যূথিকাদেবীকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হল। যূথিকাদেবীর বক্তব্য, তাঁর স্বামী যে মৃত, ওই চিঠিতেই তা মেনে নেওয়া হয়েছে। এর পরে ডেথ সার্টিফিকেট পেতে বাধা কোথায়?
যূথিকাদেবীর অভিযোগ, ব্যাঙ্ক-বিমা সংস্থার কর্তাদের কাছে দরবার করলে তাঁরা বলেছেন, ‘‘সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার সম্ভব নয়।’’ ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবে জীবন বিমা কর্তৃপক্ষ কি এগিয়ে আসতে পারতেন না ওই মহিলার সহায়তায়? জীবন বিমা নিগমের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “রেলের ওই চিঠি ডেথ সার্টিফিকেটের বিকল্প হিসাবে গ্রাহ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে আইন আইনের পথেই চলবে।” কার্যত একই কথা বলেছেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষও।
এমনকী প্রসেনজিৎবাবু ২০১০ সালে তাঁর স্ত্রীর চার ভরি সোনার গয়না বন্ধক রেখে ৪৩ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন একটি বেসরকারি গয়না বন্ধক সংস্থা থেকে। সেই সংস্থাও জানিয়েছে, স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট না আনলে গয়না ফেরত দেওয়া হবে না। পরে যূথিকাদেবী জানতে পারেন, গয়না নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কেন? সংস্থার সালকিয়া শাখার জেনারেল ম্যানেজার বিদ্যুৎ সাহার কথায়, “এক বছর ধরে কারও সুদ বাকি থাকলে জিনিস নিলাম করে দেওয়াই সংস্থার নিয়ম।”
আইনমাফিক ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়ার কোনও উপায় এখন আছে কি? স্বরাষ্ট্র দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “দেহ শনাক্ত না হলে নিখোঁজ হিসেবেই দেখাতে হবে। সাত বছর পরে আইনমাফিক ওই ব্যক্তির ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া যায়।” সেই কারণে রাজ্য সরকারের তরফে যূথিকা দেবীকে যে তিন লক্ষ টাকার যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে প্রসেনজিৎকে নিখোঁজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। |
|
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সেই চিঠি। |
রেল তা হলে চিঠিতে কী ভাবে প্রসেনজিৎবাবুকে মৃত বলে দেখাল? দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ডের আগে এই ধরনের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে আপৎকালীন অনুদান হিসেবে দু’লক্ষ টাকা করে দেওয়া হত। জ্ঞানেশ্বরীর ঘটনার সময় থেকে তা পাঁচ লক্ষ করা হয়। কিন্তু যাঁদের ক্ষেত্রে ডেথ সার্টিফিকেট নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে এই টাকা দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে রেল। সমস্যা কাটাতে রেল বোর্ড তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি যূথিকা-সহ এই ধরনের ১৮টি পরিবারকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার ভিত্তিতেই রেল জানতে পারে, ওই ১৮ জনের নিখোঁজ আত্মীয়েরা ওই ট্রেনেই সে দিন ভ্রমণ করছিলেন। তার পরেই ওই পরিবারগুলিকে অনুদানের ৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই অনুদানের চিঠি দিতে গিয়েই একটি চিঠিতে ভুলবশত মৃত্যু কথাটা লেখা হয়ে গিয়েছে বলে রেলের শীর্ষ কর্তাটি জানিয়েছেন। তা হলে এত দিন ওই চিঠির বয়ান সংশোধন হয়নি কেন? ওই কর্তার বক্তব্য, “বিষয়টি আমরা জানতামই না।”
যূথিকাদেবীর আক্ষেপ, “মুখে সবাই মানবিকতার কথা বলেন।
কিন্তু কাজের সময় সবাই আইনের দোহাই দিচ্ছেন!” |
—ফাইল চিত্র |
পুরনো খবর: স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট চেয়ে রাজভবনে যূথিকা |
|
|
|
|
|