|
|
|
|
জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনার তিন বছর |
স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট চেয়ে রাজভবনে যূথিকা |
দীক্ষা ভুঁইয়া • কলকাতা |
তিন বছর পেরিয়ে গিয়েছে। সরকারের খাতায়, তাঁর স্বামী নিখোঁজ। যূথিকা আটা-র নিজের বিশ্বাস, স্বামী বেঁচে নেই। ক্ষতিপূরণ বাবদ যে টাকা দিয়েছে সরকার, সেই সম্বল শেষ হতে চলেছে। বাড়িতে সত্তরোর্ধ্ব শ্বশুর-শাশুড়ি, আট বছরের মেয়ে। চারটি পেট চালাতে আরও অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ আসতে পারে স্বামীর জমানো সঞ্চয় থেকে। কিন্তু তার জন্য চাই ‘ডেথ সার্টিফিকেট’। স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট চেয়ে প্রশাসনের কর্তাদের দরজায় দরজায় ঘুরে বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত যূথিকা মঙ্গলবার রাজ্যপালের শরণাপন্ন হলেন। তিন বছর আগে, ২০১০ সালের ২৮ মে হাওড়া-কুরলাগামী জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের যাত্রী ছিলেন হাওড়া সালকিয়ার ব্যবসায়ী প্রসেনজিৎ আটা। বেলাইন ট্রেনটির সঙ্গে মালগাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে কামরাগুলি এমন ভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল যে, নিকটাত্মীয়েরাও সব ক্ষেত্রে প্রিয়জনের দেহ শনাক্ত করতে পারেননি। প্রসেনজিৎবাবু তেমনই এক জন, অনেক চেষ্টা করেও যাঁকে সে দিন শনাক্ত করতে পারেননি যূথিকাদেবী। তিন বছর ধরে হন্যে হয়ে বিভিন্ন মর্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। |
|
তিন বছর আগে দুর্ঘটনাস্থলে যূথিকা। |
মর্গে পড়ে থাকা মৃতদেহের মধ্যে তাঁর স্বামী রয়েছেন কি না, তা জানতে দু’বার ডিএনএ পরীক্ষাও করিয়েছেন। তাতেও জানতে পারেননি প্রসেনজিৎবাবুর পরিণতি! সরকারি খাতায় আজও তাই যূথিকার স্বামী ‘নিখোঁজ’। যূথিকাদেবী কিন্তু বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, সরকারি নির্দেশে আবার ডিএনএ পরীক্ষা হলেও তিনি আর স্বামীকে পাবেন না। তাঁর কথায়, “দলা পাকানো মৃতদেহের স্তূপ থেকে নিজের লোককে খুঁজে বের সহজ কাজ ছিল না। ফলে অনেকেই নিজের মনে করে অন্যের দেহ নিয়ে চলে গিয়েছেন। আমার ধারণা, স্বামী মৃত হলেও তাঁর দেহ আর আমি পাব না।” কিন্তু মাঝখানে সরকারি নিয়মের জালে আটকে পড়ে তাঁর সংসার পথে বসতে চলেছে। কী সেই নিয়ম? প্রশাসন সূত্রের খবর, কোনও নিখোঁজ ব্যক্তিকে ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করতে হলে ১৪ বছর অপেক্ষা করতে হবে। একমাত্র তার পরই ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ দিতে পারে সরকার। জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনার পরে রেল মন্ত্রক দুর্ঘটনাগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে এককালীন পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। গত তিন বছর সংসার চালিয়ে সেই টাকা প্রায় শেষ হতে চলেছে। যূথিকাদেবীর কথায়, “স্বামীর ছোট একটি ব্যবসা ছিল। সেটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্ক এবং বিমা সংস্থায় তাঁর নামে কিছু টাকা রয়েছে। তারা জানিয়েছে, স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া সেই টাকা তোলা যাবে না।” |
|
মঙ্গলবার রাজভবনে উপস্থিত ছিলেন যূথিকার মতো অনেকেই। |
কিন্তু ক্ষতিপূরণ ছাড়াও তো দুর্ঘটনা-কবলিত যাত্রীদের পরিবারের এক জনকে চাকরি দেবে বলে ঘোষণা করেছিল রেল! স্নাতক যূথিকাদেবী সেই চাকরি পেতে আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু রেলের কর্তারাও জানিয়েছেন স্বামী যে মৃত, তার প্রমাণ হিসাবে ডেথ সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। যূথিকার প্রশ্ন, “ব্যাঙ্ক-বিমা-রেল মন্ত্রক সকলেই স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট চাইছে। কোথায় পাব তা!”যূথিকাদেবী জানান, সংসারের প্রয়োজনে এক বার তাঁর কিছু গয়না বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন প্রসেনজিৎবাবু। ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে পেয়ে সেগুলো ছাড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেও শুনতে হয়েছে, স্বামীর নামে ঋণ রয়েছে। তাই প্রসেনজিৎবাবুর ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া গয়না ফেরত দেওয়া যাবে না। যূথিকাদেবী এখন মহাকরণ থেকে রাজভবনের দ্বারস্থ। তাঁর আর্জি, ডেথ সার্টিফিকেট পেতে আরও এগারো বছর অপেক্ষা করতে হলে সংসারটা ভেসে যাবে! |
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
পুরনো খবর: জ্ঞানেশ্বরী ঘটিয়েছিল মাওবাদীরাই: মুখ্যমন্ত্রী |
|
|
|
|
|