হাওড়া উপনির্বাচন রাজ্য রাজনীতি কোন পথে,
উত্তর হাওড়াতেই
ছর চারেক আগে এক বৃদ্ধ শহর থেকে গ্রামে ঘুরেছিলেন চরকির মতো। চষে ফেলেছিলেন হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা এলাকার অলিগলি। আজ তিনি নেই। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে একই ভাবে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে তাঁর দলের নেত্রী থেকে ছোট-বড় সব নেতাকেই।
সেই বৃদ্ধের মৃত্যুতেই হাওড়া লোকসভা আসনে উপনির্বাচন হচ্ছে। আর সেই উপনির্বাচন পশ্চিমবঙ্গকেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে!
কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়ে ২০০৯ সালে হাওড়ার সাংসদ হয়েছিলেন অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মৃত্যুজনিত অকাল ভোটে কেন্দ্রে সরকারের কিছু এসে যাবে না। অম্বিকাবাবুর দলও লোকসভায় বিশেষ কিছু অর্জন করবে না। তবু এই উপনির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রাজ্য। এক দিকে যেমন তৃণমূলের একদা জোটসঙ্গী কংগ্রেস আসন্ন পঞ্চায়েত ও আগামী লোকসভা ভোটে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বাড়াতে পারবে কি না, তার পরীক্ষা হবে, তেমনই গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে কোণঠাসা প্রধান বিরোধী দল সিপিএম উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে কি না, তারও ইঙ্গিত মিলবে। অন্য দিকে, গত দু’বছরে নানা ঘটনা এবং সাম্প্রতিক সারদা কাণ্ডের পরেও গত বারের তুলনায় ব্যবধান বাড়িয়ে জয় পেলে বাড়তি উদ্যমে অর্জন করবে তৃণমূল!
কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রার্থী অম্বিকাবাবু চার বছর আগে জিতেছিলেন প্রায় ৩৭ হাজার ভোটে। কিন্তু ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁর এলাকার সাত কেন্দ্রে তৃণমূলের ‘লিড’ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১ লক্ষ ৮৫ হাজার! তা সত্ত্বেও খানিকটা নজিরবিহীন ভাবে এই উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে প্রচারে নেমেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাধারণ ভাবে তাঁকে যা করতে দেখা যায়নি। বালি থেকে পাঁচলা বা আন্দুলে গিয়ে মমতা বলছেন, “হাওড়ায় কোনও উন্নয়ন হয়নি। আমাকে কাজ করতে দিন। প্রসূনকে বিপুল ভোটে জয়ী করলে আমাদের হাত আরও শক্ত হবে।” জেলা পরিষদ তো বটেই, হাওড়া ও বালি পুরসভা এখনও তৃণমূলের হাতে নেই। প্রসূনবাবুকে বিপুল ভোটে জেতাতে পারলে ওই তিন জায়গাতেও আধিপত্য বিস্তারের রাস্তা খুলবে মমতার জন্য। প্রসূনবাবুও বলছেন, “আমি রাজনীতি মানে বুঝি উন্নয়ন। হাওড়ার মানুষ আর কিছু চান না। ওঁরা আমার কাছে বলছেন, একটু পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দেবেন। কেউ বা বলছেন, আমাদের এলাকায় একটা পাকা রাস্তা চাই। আমি বিষয়টা উপভোগ করছি!”
প্রসূনবাবুর জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত তৃণমূল শিবির। কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থী, আইনজীবী সনাতন মুখোপাধ্যায়ের প্রচারে গিয়ে প্রদীপ ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে মানস ভুঁইয়ারা বলছেন, গত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে জোট ছিল। অম্বিকাবাবু ও তার পরে তৃণমূলের বিধায়কদের জয়ের পিছনে কংগ্রেসের ভোটও আছে। এ বার সেই ভোটের পুরোটা তৃণমূলের ঝুলিতে পড়বে না। জেলার কংগ্রেস বিধায়কঅসিত মিত্রের কথায়, “বাংলায় সিপিএম-বিরোধী লড়াই যে কংগ্রেস ছাড়া করা সম্ভব নয়, তা এ বারে ৃণমূল বুঝবে!” বস্তুত, কংগ্রেসের নিজস্ব পরম্পরাগত সমর্থনের সঙ্গে বিরোধী দল হিসেবে কতটা ভোট বাড়িয়ে নিতে পারবে, তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করছে হাওড়ার চূড়ান্ত ফল।
তৃণমূল নেতৃত্বের কটাক্ষও স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের এই উপনির্বাচনে এককাট্টা করেছে। সাঁকরাইলের কান্দুয়া অঞ্চলের কংগ্রেস নেতা সালাউদ্দিন খান বা অমরেন্দ্র নস্করের মতো অনেকেই বলছেন, “বলা হচ্ছে, হাওড়ায় কংগ্রেস নেই। সেটা এ বার দেখিয়ে দেব!” আর জগৎবল্লভপুরে প্রচারের ফাঁকে সনাতনবাবুর মন্তব্য, “রাজ্যে যে ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, তার জবাব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি এই ভোটে।”
প্রায় একই বক্তব্য সিপিএম প্রার্থী, শিবপুরের বেসু-র প্রাক্তনী শ্রীদীপ ভট্টাচার্যেরও। শালিমার, বকুলতলা এলাকায় প্রচার শেষে শ্রীদীপবাবু বলেন, “এই উপনির্বাচন আমাদের কাছে, মানুষের কাছে একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সরকারের দু’বছরের কাজে সব শ্রেণির মানুষের বিরক্তি বাড়ছে। গণতন্ত্র ভয়ঙ্কর ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। নারীদের নিরাপত্তার অভাব। দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।” এই নির্বাচন শাসক দলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে সরকারকে সতর্ক-বার্তা দেওয়ার সুযোগ, হাওড়ার মানুষকে বলছেন শ্রীদীপবাবু। কিন্তু দু’বছর আগে তৃণমূলের ‘লিড’ কি অতিক্রম করা সম্ভব? সিপিএমের প্রাক্তন হাওড়া জেলা সম্পাদকের দাবি, “মানুষের মনোভাব বদলেছে। রাজনৈতিক সমীকরণেরও পরিবর্তন হয়েছে।”
রাজনৈতিক সমীকরণের পরিবর্তন বলতে শ্রীদীপবাবু যেমন কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভাঙার কথা বলেছেন, তেমনই কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করেন, শেষ মুহূর্তে বিজেপি প্রার্থী প্রত্যাহার করায় তৃণমূলের সঙ্গে তাদের ‘গোপন আঁতাঁত’ স্পষ্ট হয়েছে। বিজেপি-র সব ভোট তৃণমূলের দিকে যাবে কি না, তা অবশ্যই অনুমানসাপেক্ষ। কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের মতে, “বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের আঁতাঁতের সন্দেহ জেগেছে হাওড়ার সংখ্যালঘুদের মনেও।” হাওড়া লোকসভায় সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ২১%। সেই দিকে নজর রেখেই তৃণমূল-বিজেপি আঁতাঁতের প্রসঙ্গ এনে সরব হয়েছে কংগ্রেস-সিপিএম।
তবে আমতার প্রসূন বাকুলি বা লস্করপুর অঞ্চলের তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যদের দাবি, সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে তাঁদের সরকার যে কাজ করেছে, তাতে ভোটব্যাঙ্ক শক্তিশালীই হয়েছে। পাঁচলার মানিকপীরের গৃহবধূ মুনমুন মাইতিও এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নতির বিবরণ দিয়ে বলছেন, “উন্নয়নই দিদির সরকারের অস্ত্র।” বালির জি টি রোডের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “হাওড়ায় এত দিন পরিকল্পনা করে উন্নয়ন হয়নি। এখন মুখ্যমন্ত্রী হাওড়ার জন্য আলাদা পুলিশ কমিশনারেট করায় যান চলাচল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে।”
এ সবের মধ্যেও বালি ও উত্তর হাওড়ায় শাসক দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাশের এলাকায় তৃণমূলের পরিবেশবিদ তপন দত্তের খুন হওয়ার ঘটনা তৃণমূলের অন্দরে চিন্তার কারণ রেখে দিয়েছে। এই দুই এলাকায় ভোটবাক্সে যাতে কিছু বিরূপ প্রভাব না পড়ে, তার জন্য মমতা দলের শীর্ষ নেতাদের নজর দিতে বলেছেন। আবার সাঁকরাইল, পাঁচলার মতো এলাকায় সিপিএমের প্রচার-সভায় ভিড়ের বহর এবং আইনজীবী হিসেবে কংগ্রেস প্রার্থীর পরিচিতিও ভাবাচ্ছে তৃণমূলের কিছু স্থানীয় নেতাকে। নবীন প্রজন্মের নেতারা অবশ্য এ সব ধর্তব্যেই আনছেন না। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো তথা তৃণমূল ‘যুবা’র সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মহল মনে করছে, লক্ষাধিক ভোটে জয় নিশ্চিত!
কলকাতার চেয়ে ২০০ বছরের বড় ‘দাদা’ হাওড়ায় এ বারে ‘দিদিগিরি’ই কায়েম থাকে কি না, জানাবে জনতা!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.