|
|
|
|
|
টিফিন ক্যারিয়ারটা আর
ব্যবহার করতে পারব না
ডেরেক ও’ব্রায়েন |
|
বিশ্বখ্যাত চিত্রপরিচালক হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই কিন্তু বিজ্ঞাপন জগত ঋতুপর্ণ ঘোষকে জিনিয়াস বলে জানত। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি। তখনই ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম শিরোনামে আসে।
আমি সে সময় ‘ওগিলভি অ্যান্ড ম্যাথার’-এ কাজ করি। আমরা শুনছিলাম, রাম রে-র ‘রেসপন্স’-এ এক জন দুর্দান্ত কপিরাইটার আছে। ইংরেজি ভাষার বিজ্ঞাপনগুলো সে শুধু বাংলায় অনুবাদ করে ছেড়ে দেয় না। বরং সেগুলোকে মৌলিক বাংলা বাক্য, বাঙালি ভাবনায় রূপান্তর করে আদ্যন্ত বাংলা বিজ্ঞাপন করে তোলে।
‘শারদসম্মান’-এর বিজ্ঞাপন-প্রচার যখন শুরু হবে, আমরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ‘শারদসম্মান’ সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত কলকাতার দুর্গাপুজোর পয়লা নম্বর পুরস্কার। ঋতুপর্ণ তখন নিয়ম করে
লাঞ্চ ব্রেকের সময় আমাদের ওগিলভি-র অফিসে আসত ‘শারদসম্মান’-এর জন্য কাজ করতে (বিজ্ঞাপনের জগতে এটাই দস্তুর, যাকে বলে মুনলাইটিং)। এবং যেমনটি ভাবা গিয়েছিল, প্রতিদিনই ওর অসামান্য কাজ দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম। এখনও পর্যন্ত শারদসম্মানের ক্যাম্পেন বাংলা বিজ্ঞাপনে সাফল্যের অন্যতম মাইলফলক।
বিজ্ঞাপনের মানুষ হিসেবে ডিটেলের প্রতি ঋতুপর্ণর চোখ ছিল দারুণ তীক্ষ্ন। সেটা লেখাই হোক বা ছবিই হোক। কোন পেনে লেখা হবে, কী রকম আলো হবে, ঠিক কোন শব্দটা ব্যবহার হবে এগুলো নিয়ে ওর ভীষণ খুঁতখুঁতানি ছিল। সেটা মাঝেমাঝে প্রায় পাগলামির জায়গায় চলে যেত। তখন আমরা জানতাম না যে, ঋতুপর্ণ আসলে ধীরে ধীরে ওর সিনেমার কেরিয়ারের জমিটা তৈরি করে চলেছে। ঋতুপর্ণর ছবি দেখাটা যে কারণে কখনওই খুব সহজ ব্যাপার নয়। আলগা ভাবে দেখলে অনেক অনেক জিনিস ‘মিস’ করে যেতে হয়।
একটা ব্যাপার অবশ্য তখন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কলকাতার বিজ্ঞাপন দুনিয়াটা ঋতুপর্ণর মতো মানুষের জন্য খুবই ছোট। কাজের ক্ষেত্রে ওর যা উদ্যম, তার মাপেও বিজ্ঞাপনের কলকাতাটা বহরে ছোট। ঋতুপর্ণ অনেক দিক থেকেই সত্যজিৎ রায়ের দেখানো রাস্তায় হেঁটেছে। এ ক্ষেত্রেও সত্যজিতের মতোই সে বিজ্ঞাপনের চাকরি ছেড়ে চিত্রপরিচালক হল। সুন্দরের পূজারী বলতে আমি যা বুঝি, আমার চোখে ঋতুপর্ণ তা-ই। আমার পছন্দের ওর সেরা তিনটি ছবি বাছতে বললে আমি বাছব ‘চোখের বালি’, ‘রেনকোট’ আর ‘দ্য লাস্ট লিয়র’। প্রথমটা বাংলা, দ্বিতীয়টা হিন্দি এবং তৃতীয়টা ইংরেজি। এর থেকেই ঋতুপর্ণ সম্পর্কে, ওর কাজের পরিধি সম্পর্কে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
নয়ের দশকের গোড়ায় আমরা দু’জনেই অন্য কাজ করব বলে বিজ্ঞাপনের চাকরি ছেড়ে দিই। অবশ্যই ঋতু আমাদের সকলকে পিছনে ফেলে অনেক অনেক এগিয়ে গেল। আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটি হয়ে উঠল। আজ কার্লোভি ভ্যারি, তো কাল নিউ ইয়র্কে ওকে নিয়ে হইচই শুরু হয়ে গেল। বছর আষ্টেক আগে আমি বাড়ি বদলালাম। তার পর থেকে আমি ঋতুপর্ণর পড়শি। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে আমাদের বাড়ির একটা গলি পরেই ওর বাড়ি। ৫০০ মিটার দূরত্বও নয়। আমাদের বন্ধুত্বটা আবার নতুন করে বাড়ল, সত্যি বলতে কী আরও গভীর হল।
সাহসী, নির্ভীক মানুষ ছিল ঋতুপর্ণ। গোঁড়ামির বিরোধিতা করতে পিছপা হতো না। নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে নিজের মতো করে বাঁচত। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও ওর খুবই বন্ধুত্ব ছিল। বহু সন্ধে আমরা কখনও সিনেমা, কখনও বিজ্ঞাপন, কখনও সমকামী আন্দোলন, কখনও সংস্কৃতির অর্থনীতি নিয়ে গল্প করে কাটিয়েছি। ঋতুপর্ণ ছিল সেই সব আড্ডার প্রাণ।
অনেক বার ঋতু আমাদের বাড়িতে এসেছে ডিনারে। বড়দিনে তো আসতই, তা ছাড়াও বছরে আরও তিন-চার আসা হতোই। তবে ও কোনও দিনই রাত দশটা-সাড়ে দশটা পর্যন্ত থেকে ডিনার করতে পারত না। ডায়াবেটিসের ইঞ্জেকশন নিতে হতো ওকে, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ত। সে জন্য বলত, ওর খাবারটা টিফিন ক্যারিয়ারে দিয়ে দিতে। ওটাই রুটিন হয়ে গিয়েছিল আমাদের বাড়িতে। পর দিন সকাল ঠিক সাড়ে ন’টায় অবধারিত ভাবে টিফিন ক্যারিয়ারটা ফেরত আসত। মেজেঘষে ঝকঝকে।
এই লেখাটা যখন লিখছি, রান্নাঘরে দেখতে পাচ্ছি টিফিন ক্যারিয়ারটা। ওটা আর কখনও ব্যবহার করতে পারব বলে মনে হয় না। বিদায় বন্ধু। স্বর্গ আজ থেকে আরও সম্পদশালী হল। |
|
|
|
|
|