|
|
|
|
দু’বছরেই বেতন হয়েছিল ৫০০ থেকে ১০ হাজার
গার্গী গুহঠাকুরতা • কলকাতা |
ঠিক যেমনটা বিখ্যাতদের জীবনে ঘটে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে চাকরির খোঁজে হন্যে। কিন্তু বরাতে বরাদ্দ শুধুই প্রত্যাখ্যান। শেষমেশ বিজ্ঞাপন তৈরির এজেন্সিতে শিক্ষানবিশ কপিরাইটারের কাজে হাতেখড়ি। মাসমাইনে ৫০০ টাকা। দু’বছর যেতে না যেতেই ডাক আর এক সংস্থা থেকে। এ বার বেতন ১০ হাজার!
তাঁর তখনকার সহকর্মীরা আজও বলেন, সেই নতুন চাকরির চিঠি নিয়ে বস্-কে চেপে ধরেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। এ দেশে বিজ্ঞাপন জগতের অন্যতম কিংবদন্তি সেই বস্-কে তাঁর সটান প্রশ্ন ছিল, “বাজারে আমার এই দাম। তা তো কখনও স্বীকার করেননি আপনি?” বস্-এর সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, “দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্ম বোঝে নাকি?”
বৃহস্পতিবার সকালে যে ঋতুপর্ণ অতীত হয়ে গেলেন, তাঁর স্মৃতিতে সিনেমা-জগৎ যে শ্রদ্ধায় আনত হবে, তা আর নতুন কথা কী? ডজনখানেক জাতীয় পুরস্কার যে পরিচালকের ঝুলিতে, তাঁর শেষযাত্রা যে রুপোলি পর্দার মানুষদের ভিড়ে উপচে পড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এ দিন স্মৃতির পাতা উল্টোতে গিয়ে বিজ্ঞাপনের মনকাড়া স্লোগান লেখা ঋতুপর্ণকেও মনে পড়ল অনেকের। যাঁরা মনে করেন, শুধু বাংলা সিনেমা নয়, বাংলা বিজ্ঞাপনের ছাঁদ বদলে দেওয়ার পিছনেও ঋতুপর্ণের কলমের অবদান যথেষ্ট।
বোরোলীনের সেই ক্যাচলাইন ‘জীবনের ওঠা-পড়া যেন সহজে গায়ে না লাগে’ কিংবা ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’। মার্গো সাবানের সেই অমোঘ সম্মোহন ‘দেখতে খারাপ, মাখতে ভাল’। ব্রিটানিয়া বিস্কুটের ‘তোমার সকাল-আমার সকাল...।’ উদাহরণ অজস্র। তাই অ্যাড ক্লাবের পুরস্কার পাওয়াটা এক সময় তাঁর অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আসলে ইংরেজি বা হিন্দি-কে শুধু আক্ষরিক অনুবাদ না-করে বাংলাতেও যে বিজ্ঞাপনের নিজস্ব ভাষা তৈরি করা যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ।
চিত্রপরিচালক অনীক দত্ত এবং অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী দু’জনেরই মূল রুজি এখনও বিজ্ঞাপনের দুনিয়া থেকে। কপিরাইটার হিসেবে। আরও একটা মিল রয়েছে। এঁরা দু’জনেই ঋতুপর্ণের বিজ্ঞাপনী স্লোগানের অসম্ভব ভক্ত। তাঁদের মতে, ওই স্লোগানগুলো সংক্ষিপ্ত কিন্তু নজরকাড়া। অনেক ভাবনা-চিন্তার ফসল, অথচ প্রাঞ্জল।
অনীক বলছিলেন, “আশির শেষ বা নব্বই দশকের গোড়ায় বাংলা বিজ্ঞাপনের মান উঁচু ছিল না। কারণ, হিন্দি আর ইংরেজি অনুবাদ করে যা দাঁড়াত, অনেক সময় তার মানে বোঝাই শক্ত হত। সেই অবস্থাটাই বদলে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। বিজ্ঞাপনের জগতে থাকলেও সে সময় ব্যক্তিগত ভাবে ওঁকে চিনতাম না। তবে বাংলা কপিরাইটার হিসেবে নাম শুনেছিলাম অবশ্যই। ওঁর লেখার মুন্সিয়ানার কারণে। ওঁর লেখা বিজ্ঞাপনে অনুপ্রাণিত হয়েই আমার কপিরাইটিংয়ে আসা।”
অনীক, অনিরুদ্ধর মতো অনেকেই মনে করেন, ঋতুপর্ণের সিনেমা তৈরিতেও তাঁর বিজ্ঞাপনী প্রশিক্ষণের ছাপ থাকত সর্বত্র। ছোট-ছোট জিনিসেও তীক্ষ্ন নজর। শিল্প নির্দেশনার ক্ষেত্রে খুঁতখুঁতে মনোভাব। পর্দায় দর্শকের চোখ চুম্বকের মতো টেনে রাখার ক্ষমতা। সৃজনশীলতার সঙ্গে প্রতি পরতে বাস্তব বুদ্ধির
মিশেল। অনীক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ঋতুপর্ণের সিনেমা তৈরির পুরো ‘টিম’টাই উঠে এসেছিল বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকে।
আর অনিরুদ্ধর কথায়, “বিজ্ঞাপন জগতের শিক্ষার স্পষ্ট ছাপ ওঁর ছবিতে। যে সব দর্শক ছবির মূল লক্ষ্য, সেই ‘টার্গেট অডিয়েন্স’-এর কাছে সহজে পৌঁছে যেতে পারার শিক্ষা তো বিজ্ঞাপন দুনিয়া থেকেই পাওয়া। মাত্র কয়েকটি শব্দে মূল বার্তা তুলে ধরতে ঋতুপর্ণর জুড়ি মেলা শক্ত।”
অনেকের মতে, ঋতুপর্ণের জীবনটাও শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞাপনী ছবির মতো হয়ে দাঁড়াল। সংক্ষিপ্ত অথচ সফল। কম কথায় বাঙ্ময়। জাতীয় পুরস্কার থেকে বিতর্ক কারণ যা-ই হোক, তাঁর জীবন থেকে প্রচারের আলো সরলো কই? ‘আল্টিমেট অ্যাড ম্যান’ই রয়ে গেলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। |
|
|
|
|
|