|
|
|
|
ঠাট্টা করে বলতেন, বাঙালি মৃত্যুকে ভালবাসে
ইন্দ্রনীল রায় • কলকাতা |
সে দিন ঋতুপর্ণ ঘোষের বাবা মারা গিয়েছেন। অজস্র লোকের ভিড় তাঁর ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে।
ঋতুদা নিজে ভিতর ভিতর ভেঙে পড়লেও আত্মীয়স্বজনের সামনে শোক দেখাচ্ছেন না। উল্টে ইয়ার্কি মারছেন।
পাশেই বসেছিলেন পরিচালক মৈনাক ভৌমিক। ঋতুপর্ণ তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখবি, বাঙালি মৃত্যু কী রকম ভালবাসে?” তত ক্ষণে পাড়ার সবাই এসে হাজির। ঋতুদা হঠাৎ তাঁদের উদ্দেশে বলে উঠলেন, “সত্যি বাবা চলে গেল! দোতলার বারান্দাটায় আর কেউ কোনও দিন বসবে না!” বলামাত্র জমাট ভিড়টা ডুকরে কেঁদে উঠল।
ঋতুপর্ণ চোখ টিপে মৈনাককে বললেন, “দেখেছিস, আমি বাঙালিকে কত চিনি! বাঙালি মৃত্যুকে বড্ড ভালবাসে।”
ঋতুপর্ণের সে দিনের কথাটা এ দিন বড় সত্যি মনে হচ্ছিল। বাঙালি সত্যিই মৃত্যুকে ভালবাসে। কিন্তু বৃহস্পতিবার মেঘলা সকাল এটাও প্রমাণ করল, বাঙালি ঋতুপর্ণ ঘোষকে কতটা ভালবাসত।
বেলা তখন পৌনে দশটা। ভিতরের ঘরে বসে একা একা কাঁদছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন “আমি ওই ঘরে ঢুকতে পারব না। ঋতুকে আমি ওই ভাবে দেখতে পারব না।” এ দিন সকালে ডাবিং করতে করতেই খবরটা পান প্রসেনজিৎ। নিজের গাড়ি ছিল না বলে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের গাড়ি করে পৌঁছন ইন্দ্রাণী পার্কে।
তার আগেই পৌঁছে গিয়েছেন শ্রীকান্ত মোহতা, মহেন্দ্র সোনি, অরূপ বিশ্বাস, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীরা। সবার চোখেমুখে অবিশ্বাস। |
|
স্তম্ভিত অপর্ণা সেন। ঋতুপর্ণের বাড়িতে। — নিজস্ব চিত্র
|
ঋতুপর্ণের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা সবাই জানেন তাঁর ঘরে সব সময় দু’টো এসি চলে। এ দিনও তাই চলছিল। এসির রিমোটটা বালিশের পাশে রাখা। শুধু রিমোট চালানোর লোকটাই নেই।
বুধবার থেকেই নাকি শরীর
ভাল যাচ্ছিল না। সন্ধেবেলা
শ্রীকান্ত মোহতার সঙ্গে ‘দেবী চৌধুরানী’ নিয়ে মিটিং করারও কথা ছিল। “বিকেলে আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আজকে শরীরটা ভাল নেই। কালকে সকালে আয়।’ সকালে এলাম ঠিকই। কিন্তু
মিটিং করব কার সঙ্গে?” চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন শ্রীকান্ত।
আগের দিন থেকে শরীরটা যে ভাল ছিল না, কিছু লোক জানতেন। গলফ গার্ডেনের চাইনিজ রেস্তোরাঁ ‘চাওম্যান’ থেকে খাবার অর্ডার করেছিলেন। লেমন পিপার সুপ এবং চিকেন উইথ বেসিল। বলেছিলেন, রাত আটটার মধ্যে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন! তাই যদি একটু তাড়াতাড়ি অর্ডারটা ডেলিভারি করা হয়! ডিনার করে রেস্টুরেন্টে ফোন করে জানিয়েওছিলেন, খাবার খুব ভাল হয়েছে। এ রকম নানা গল্প তখন ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে।
তত ক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন অপর্ণা সেন। সঙ্গে কল্যাণ রায়। গলির মুখ থেকেই অঝোরে কাঁদছেন অপর্ণা। ঋতুপর্ণ যে ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন, সেই ঘরে গিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা তাঁর আদরের ঋতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাঁদতে কাঁদতে ঢুকলেন দেবশ্রী রায়। কথাই বলতে পারছেন না।
আসলে টলিউডে এত বড় ইন্দ্রপতন ইদানীং কালে খুব কমই হয়েছে। এবং মৃত্যুর এই আকস্মিকতাই নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে।
কাল পর্যন্ত যে মানুষটা প্রসেনজিৎকে ট্যুইট করেছেন, সেই মানুষটা যে আর ঘুম থেকেই উঠবেন না, ভাবতে পারেননি কেউ। |
|
দেবশ্রী রায় ও রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র |
“এটা কী হল বলো তো? এটা কী হল?” গৌতম ঘোষের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। “ঋতু কত ছোট, কী বলব আর!” নিজের মনে বলছেন সৌমিত্র। ঋতুপর্ণের নীচের ঘর তখন লোকে লোকারণ্য। সৌমিত্রবাবুর শরীর খারাপ লাগছিল। ধীরে ধীরে বেরোলেন ঘর থেকে। সামনে তখন মাধবী মুখোপাধ্যায়। দু’জনেই চুপ।
তার আগেই পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে বসার চেয়ার থেকে প্যান্ডেল সব
কিছুর ব্যবস্থা হচ্ছে। বাড়ির লোকজনের আপত্তি ছিল শবদেহ নন্দন কিংবা টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োয় নিয়ে
যাওয়ার ব্যাপারে। তাঁদের বোঝানোর দায়িত্ব নিলেন ঋতুর শেষ ছবি ‘সত্যান্বেষী’র অজিত, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। তত ক্ষণে বাইরে
কাতারে কাতারে মানুষ। তাঁদের মধ্যে থেকে এক ষাটোর্ধ্ব মহিলা কান্না জড়ানো ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন, “ছোটবেলা থেকে ঋতুকে দেখছি, এক বারটি ভেতরে ঢুকতে দিন না! শেষ বারের মতো ওর মুখটা দেখতে চাই কাছ থেকে!”
শেষ বারের মতো সাজানো
শুরু হল ঋতুপর্ণকে। “টালিগঞ্জের অন্যতম শৌখিন মানুষ ছিলেন ঋতুদা। আমার বিয়ের চন্দনটাও পরিয়ে দিয়েছিলেন”, বলছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি ঋতুপর্ণের খাটের এক পাশে দাঁড়িয়ে। ঋতুদাকে আচকান পরিয়ে দিলেন। পাগড়িটাও। তার পর বললেন, “আমি শুধু ঋতুদার মুখটা দেখছিলাম। অদ্ভুত একটা হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটে। খালি মনে হচ্ছিল, ঘুম থেকে উঠে বলবেন তোরা না বড্ড বাড়াবাড়ি করিস! দাঁড়া, আমি নিজেই পরে নিচ্ছি!’’ |
|
|
|
|
|