|
|
|
|
আবহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বিদায় ঋতুপর্ণের
ঋজু বসু • কলকাতা |
উনিশে এপ্রিল, দোসর, আবহমান...। এমন দৃশ্য বারবার ফিরে এসেছে তাঁর ছবিতে। ড্রয়িংরুমে মৃত্যুর থমথমে আবহ। সোফাসেটে বসে আছেন প্রসেনজিৎ, অপর্ণা সেন, সোহাগ সেনরা। বিমূঢ় ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন অঞ্জন দত্ত।
সব চরিত্রই যেন কাল্পনিক! যেন কোনও ছবির সেট! এই বুঝি ‘কাট’ বলে চেঁচিয়ে উঠবেন পরিচালক।
আগের দিন অবধিও টুইটারে সক্রিয়। এমনকী শ্যুটিং করতে গিয়ে গুরু দত্ত যে বাড়িতে ‘সাহেব বিবি আউর গোলাম’-এর শ্যুটিং করেছিলেন, সেই বাড়িতে পা রাখার কথাও লিখেছিলেন। গুরু দত্ত নিজের জীবনটা শেষ করে দিয়েছিলেন ৩৯ বছর বয়সে। ৫০ ছুঁতে না ছুঁতেই চলে গেলেন ঋতুপর্ণ।
কী হয়েছিল? ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন মৃণাল সেন। মুখময় প্রশান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা ঋতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন নব্বই বছরের বর্ষীয়ান চলচ্চিত্রকার। উপস্থিত সকলেরই এক কথা, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! এক ডজন জাতীয় পুরস্কার
ঝুলিতে নিয়েই থেমে যাওয়ার কথা তো ছিল না! |
|
শেষ যাত্রায় ঋতুপর্ণ ঘোষ। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক |
সত্যজিৎ রায়-পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বলতম প্রতিভূদের মধ্যে ধরা হয় ঋতুপর্ণকে। নব্বইয়ের দশকে যখন তিনি ছবি করতে এলেন, শহুরে-শিক্ষিত দর্শক তখন বাংলা ছবি দেখেন না! তাঁদের ফের হলমুখী করেছিলেন মূলত ঋতুপর্ণই। সেই সঙ্গে প্রসেনজিৎ-দেবশ্রী-ঋতুপর্ণার মতো মূলধারার ছবির তারকাদের ভিন্ন ধারার ছবিতে নিয়মিত ব্যবহার করতে শুরু করার কৃতিত্বও তাঁর। দু’টো কাজই তিনি দারুণ সফল ভাবে পারতেন। কারণ, ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই মানেন, বাঙালির মনকে অত্যন্ত ভাল বুঝতেন ঋতুপর্ণ। তা সে সিনেমা পরিচালনাই হোক, টিভিতে টক শো সংযোজনাই হোক, ফিল্ম পত্রিকার সম্পাদনাই হোক (আনন্দবাজার সংস্থার ‘আনন্দলোক’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, ১৯৯৭-২০০৪) অথবা ‘বাহান্ন এপিসোড’ বা ‘গানের ও পারে’র মতো জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিকের কাজই হোক!
দর্শকের নাড়ি বুঝতে পারার এই শিক্ষাটা অনেকটাই হয়েছিল বিজ্ঞাপনে কাজ করে। সাউথ পয়েন্ট স্কুল থেকে বেরিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। তার পরই কপিরাইটারের চাকরি। বোরোলীন, ব্রিটানিয়া, ফ্রুটি, শারদসম্মান...বাংলা বিজ্ঞাপনের ভাষা বদলে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। ’৯২ সালে চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটির জন্য প্রথম ছবি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘হিরের আংটি’। কিন্তু বাঙালি রীতিমতো চমকে গেল তার দু’বছর পরে। অনামী পরিচালকের ছবি, উনিশে এপ্রিল। আবির্ভাবেই শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়। তার পর একে একে দহন, অসুখ, বাড়িওয়ালি, তিতলি, শুভ মহরৎ, চোখের বালি...। অনীক দত্তের মতো পরিচালকরা এ দিন অকুণ্ঠ গলায় বলছিলেন, ঋতুপর্ণ রাস্তাটা দেখিয়েছিলেন বলেই এ যুগের পরিচালকদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে।
ঋতুপর্ণ নিজে অবশ্য সহজ ফর্মুলা নিয়ে খুশি থাকার পাত্র ছিলেন না। বারবার নিজেকে ভাঙচুর করতেন। তাঁর ছবির বিষয়বস্তু এবং ভাষায় একটা বড় ধরনের বাঁক-বদল দেখা যাচ্ছিল গত কয়েক বছরে। সাজপোশাক থেকে শুরু করে ছবির কাহিনি নির্বাচনে ক্রমশ সাহসী হচ্ছিলেন। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ বা ‘মেমরিজ ইন মার্চ’-এর মতো ছবিতে অভিনয়, ‘চিত্রাঙ্গদা’য় পরিচালনা ও অভিনয় তারই সাক্ষ্য বহন করছিল।
এই মুহূর্তে অবশ্য কাজ করছিলেন ‘সত্যান্বেষী’র। গত রবিবার শ্যুটিং শেষ করে সম্পাদনায় হাত দেওয়ার আগে একটু বিশ্রাম চেয়েছিলেন। বন্ধু-সহকারীদের কাউকে কাউকে বলেছিলেন, “ক’টা দিন আমায় জ্বালাস্ না!” |
|
ঋতুপর্ণের বাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র |
বুধবার রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন। এ দিন ‘দাদা’র নির্দেশ মতো ঠিক সকাল সাড়ে আটটায় ঘুম ভাঙাতে গিয়েছিলেন সাহায্যকারী বিশ্বনাথ মণ্ডল ওরফে বিশু। রোজ যে ভাবে ডাকেন, ঘরের দরজা ফাঁক করে হাঁক দিয়ে নীচে নেমে অপেক্ষা করছিলেন। সাধারণত, মিনিট ১০-১৫ বাদে ঋতুপর্ণ কলিংবেল বাজিয়ে ডাক দিলে বিশু উপরে কফি নিয়ে যেতেন। সেই কলিংবেল এ দিন আর বাজেনি। মিনিট ২০-২৫ পেরিয়ে গিয়েছে দেখে বিশু ফের ঘরে ঢোকেন। ‘দাদা’কে ধাক্কা দিয়ে তুলতে গিয়ে দেখেন, গা-হাত-পা ঠান্ডা। বুকের ধুকপুকুনি বন্ধ।
শরীর খারাপ ছিল ঠিকই, কিন্তু এ ভাবে চলে যাওয়াটা কারও হিসেবের মধ্যেই ছিল না। মাস চারেক আগে ‘সত্যান্বেষী’র শ্যুটিং শুরুর আগেই প্যানক্রিয়াটাইটিস থেকে সেরে উঠেছিলেন। ঋতুপর্ণের অন্যতম চিকিৎসক-বন্ধু কৌশিক ঘোষ বলছিলেন, “থাইরয়েডের সমস্যা, হাই ব্লাড সুগার ও রক্তাল্পতার সঙ্গে প্যানক্রিয়াটাইটিসের প্রভাবে শরীরটা ভেতরে ভেতরে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছিল। হৃদযন্ত্রও তার ফলেই সম্ভবত কমজোর হয়। ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় লড়াইয়ের সুযোগ পাওয়া গেল না।” বন্ধুদের আরও বক্তব্য, শরীরে অজস্র কাটা-ছেঁড়া, বিস্তর ওষুধ খেয়েও ঋতুপর্ণ কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। খুব ঘনিষ্ঠেরাও অনেকেই এত-শত অস্ত্রোপচারের ফিরিস্তি জানতেন না। ‘অজিত’ অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, “যেমন তেড়ে বকাঝকা দিয়ে মেজাজে শ্যুট করতেন ঋতুদা, সেই মেজাজটাই বহাল ছিল। অসুস্থতার ছাপ তো দেখিনি।”
পেটের সামান্য গড়বড় দেখা দিয়েছিল। বাড়িতে বা শ্যুটিংয়ে ছোট-বড় দরকারে তাঁর আস্থাভাজন দিলীপ পাত্র, গোবিন্দ কয়াল, বিশুরা বলেওছিলেন, ‘দাদা ডাক্তার দেখাও!’ ঋতুপর্ণ তাঁদের বলেছিলেন, ‘দাঁড়া, ক’টা দিন যাক্!’ সেই ক’টি দিন আর গেল না।
কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসছিল অপর্ণা সেনের। রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে লেখা একটা স্ক্রিপ্ট ঋতুপর্ণ প্রথম পড়ে শুনিয়েছিলেন ওঁকে। “তখনই বুঝেছিলাম, এ ছেলে অনেক দূর যাবে। তার পর থেকে ও আমাকে ওর স্ক্রিপ্ট পড়াবে না বা আমি ওকে স্ক্রিপ্ট পড়াব না, ভাবতেই পারতাম না।”
কয়েক বছর আগে মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন। তার পর থেকে একাই থাকতেন ঋতুপর্ণ। এ দিন দুপুরে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, প্রসেনজিৎদের সঙ্গে আলোচনা করে ঋতুর শেষ যাত্রার চিত্রনাট্য ছকে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো বেলা আড়াইটে নাগাদ শেষ বার ‘তাসের ঘর’ ছেড়ে বেরোন বাঙালির অন্যতম প্রিয় চলচ্চিত্রকার। বাড়ি থেকে নন্দন, ঘণ্টা তিনেক বাদে সেখান থেকে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও। টালিগঞ্জের সিরিটি শ্মশানে কলকাতা পুলিশের তরফে গান-স্যালুট দিয়ে সম্মাননা জানানো হয় তাঁকে। উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ঋতুপর্ণের শেষকৃত্য সম্পন্ন হল।
|
(সহ প্রতিবেদন: দেবাশিস দাস) |
|
|
|
|
|