|
|
|
|
বলিউডের প্রথম সারির নক্ষত্ররাও ছুটে আসতেন তাঁর কাছে
প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত • কলকাতা |
লন্ডনে ছিলেন ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন। যখন খবরটা প্রথম পৌঁছল তাঁর কাছে, তখন লন্ডনে আলো ফোটেনি। “আই অ্যাম শকড অ্যান্ড ডিপলি স্যাডেনড বাই দ্য নিউজ,” বললেন তিনি। “বিশ্বাসই করতে পারছি না খবরটা।”
“দেশে কি কোনও ভাল চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই নাকি? এ ভাবে ছেলেটা চলে গেল? কী এমন বয়স হয়েছিল ওর?” ফোন তুলে প্রথমেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন রাখী গুলজার।
বিপাশা বসু বলছেন, “আমার কেরিয়ারের অন্যতম ভাল ছবি ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। ছোট বোনের মতো দেখতেন। এই সপ্তাহেই ভেবেছিলাম ফোন করে ওর খোঁজ নেব।”
তা আর হল কই?
“ঋতুপর্ণর চলে যাওয়াটা ভারতের ক্ষতি। শুধু বাংলা নয়, ওয়র্ল্ড সিনেমাতে ও একটা জায়গা করে নিয়েছিল।” কথাগুলো দীপ্তি নাভালের। প্রথম এক বার কথা হয়েও কাজ করা হয়নি। “ভেবেছিলাম আমার বোধ হয় ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে কাজ করার সুযোগটাই শেষ হয়ে গেল,” বলেন দীপ্তি। পরে ‘মেমরিজ ইন মার্চ’-এর প্রস্তাব
পেয়েই লাফিয়ে উঠেছিলেন। “ঋতু বলেছিল, ‘অত লাফিও না, স্ক্রিন-প্লেটা আমি লিখেছি, তবে আমি
পরিচালক নই। আমি তোমার সঙ্গে অভিনয় করব।’’ |
|
দীপ্তি নাভাল মুম্বইয়ের বহু বড় বড় পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে ছবি করতে এত আগ্রহ কেন ছিল তাঁর? কী ছিল তাঁর ছবিতে যার জন্য অমিতাভ বচ্চন থেকে অর্জুন রামপাল, প্রীতি জিন্টা থেকে অজয় দেবগণ, অভিষেক বচ্চন থেকে শর্মিলা ঠাকুর সবাই কলকাতায় এসে শু্যটিং করতে রাজি হয়ে যেতেন?
“কলকাতায় থেকেও ঋতুপর্ণ এমন ‘রুটেড’ ছবি বানাত, যার জন্য বলিউডের তাবড় স্টারেরা কলকাতায় ছুটে আসত ওর সঙ্গে কাজ করবে বলে। নিশ্চয়ই মুম্বইতে শিফ্ট করার অজস্র প্রস্তাব ছিল। স্টারদের ধারণা ছিল যে, ঋতুপর্ণর সঙ্গে কাজ করলে বোধহয় সিনেমা জগতে একটা সম্মান পাওয়া যাবে।” বক্তা মহেশ ভট্ট। কলকাতায় ফিকি-র একটা অনুষ্ঠানে মহেশের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে ঠিক হয়েছিল দু’জনে একটা ছবি করবেন।
অনেকাংশেই সেটা ঠিক। তাই হয়তো বহু ক্ষেত্রেই মুম্বইয়ের অনেক স্টারকে বলতে শোনা যেত, ‘‘ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি করতে চাই।” সোহা আলি খানের দ্বিতীয় ছবি ‘অন্তরমহল’। তিনি বলছেন, সত্যজিৎ রায় আর নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছিলেন ঋতুপর্ণ। “খুব কম পরিচালকের কাছে এক জন অভিনেতা নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন। এই ভেবে যে তার সেরাটাই স্ক্রিনে ফুটে উঠবে। ঋতুদার ক্ষেত্রে সেই ভরসাটা পেতাম।” সোহা জানান। ঠিক বুঝিয়ে দিতেন কোথায় তাকাতে হবে, কোথায় হাতটা রাখতে হবে, কী ভাবে শাড়ির আঁচলটা ধরতে হবে। “আমাকে শটগুলো অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন। আমি শুধু কপি করতাম,” সোহা জানান। |
|
ঋতুপর্ণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন সৌমিত্র।—নিজস্ব চিত্র |
রাখীও বলছেন, “সূক্ষ্মতম ডিটেলের দিকে নজর ছিল ওর। আমি কী ভাবে হাঁটি, কী ভাবে নিজের পোষ্যদের ডাকি সব নজর করেছিল। আর সেগুলো ‘শুভ মহরত’-এ আমার চরিত্রে ব্যবহার করেছিল।” ‘বাড়িওয়ালি’ করার সময় প্রথম রাখীর সঙ্গে কাজ করার কথা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। তার পর নিজের হাতে লিখে একটা স্ক্রিপ্ট পাঠিয়েছিলেন। নাম ‘রাঙা পিসিমা’। “আজও রেখে দিয়েছি স্ক্রিপ্টটা। ওর মধ্যে একটা শিশুসুলভ ব্যাপার ছিল। আমি হয়তো বসে আছি, হঠাৎ দেখি ও আমার পায়ের কাছে এসে বসেছে। আমি বলতাম, ‘এ কী, ওখানে কেন?’ ও বলত, ‘এখানেই বসতে ভাল লাগে’।”
কান চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি ছিলেন নন্দিতা দাশ। দেশে ফিরেছেন বুধবার। পরের দিনই দুঃসংবাদ পেয়ে মুষড়ে পড়েছেন। “ব্যক্তি ঋতুপর্ণ এবং পরিচালক ঋতুপর্ণর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। ঋতুপর্ণ ছিলেন স্পষ্টবক্তা আর নির্ভীক। ভাল লাগত ওঁর গল্প বলার ধরন।” প্রযোজক-পরিচালক সুভাষ ঘাই ঋতুপর্ণর ‘নৌকাডুবি’ পরিবেশনার দায়িত্বে ছিলেন। জানালেন, “সিনেমায় নিজের দর্শন নিয়ে ও কখনও আপস করেনি। কলকাতাতে বসেই ও দেখিয়ে দিয়েছে যে ভাল কাজ করা সম্ভব।”
ভেঙে পড়েছেন প্রবীণ পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ঋতুপর্ণর তৈরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর তথ্যচিত্রটির জন্য। “মৌলিক চিন্তার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ও সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেনের সিনেমা বানানোর ঐতিহ্য বহন করত। সত্যজিৎ রায়ের মতো ক্লাসিকাল অ্যাপ্রোচ ছিল ওর মধ্যে। তাই বলিউডের ‘ফ্রন্ট বেঞ্চ স্টার’রাও ছুটে গিয়েছেন ওর সঙ্গে কাজ করতে।” শ্যামের মতে ‘সেক্সুয়াল ইনক্লিনেশন’টা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। “সেই বিষয় নিয়েও অনেক ভাল কাজ করার সাহস দেখিয়েছে ঋতু,” শ্যাম জানান। |
|
সেটা হয়তো পেরেছেন নিজের চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস থেকে। “মানুষকে ‘অল্টারনেটিভ সেক্সুয়ালিটি’ সম্পর্কে সংবেদনশীল করতে চেয়েছিলেন তাঁর সিনেমার মাধ্যমে। ওঁর রাস্তা ধরে
মেন স্ট্রিম বলিউডে এই বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছিল। ওঁর চলে যাওয়াতে
এই মুভমেন্টটাই না বন্ধ হয়ে যায়,” বলছেন ওনির।
এই তো সে দিন জাতীয় পুরস্কার নিতে দিল্লিতে এক প্লেনে পাশাপাশি সিটে বসে গেলেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। তখনই ঠিক হয়েছিল একসঙ্গে কাজ করবেন। “অভিনেতা বলে বুঝতে পারি যে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ছবি করাটা কঠিন। ওঁর সঙ্গে কাজ করতে পারলে আমার উত্তরণ ঘটত।” আফশোসটা থেকেই গেল নওয়াজের। |
|
|
|
|
|