|
|
|
|
বুলেটের জবাব দিতে জানি, বলতেন বস্তারের বাঘ
তাপস সিংহ • রায়পুর |
জগদলপুরের হোটেলে সে বার একটু বেশি রাতেই বেজে উঠেছিল মোবাইলটা।
‘‘আপনি ফোন করেছিলেন বাইরে ছিলাম বলে শুনতে পাইনি।’’
ফোনের ও পারে মহেন্দ্র কর্মা।
বছর পাঁচেক আগের কথা। সালওয়া জুড়ুম নিয়ে বিতর্ক তখন তুঙ্গে। স্পেশাল পুলিশ অফিসারদের (এসপিও) বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভূরি ভূরি অভিযোগ। কিন্তু প্রসঙ্গটা তুলতেই অদ্ভুত শান্ত শুনিয়েছিল মহেন্দ্র কর্মার গলা। যিনি নিজেই কিনা সালওয়া জুড়ুমের হোতা বলে পরিচিত।
মহেন্দ্র বলতে থাকেন, “মাওবাদীরা যখন আদিবাসীদের উপর অত্যাচার চালায়, নিজেরাই বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তখন সবাই চুপ করে থাকে। শুধু দোষ হয় সালওয়া জুড়ুমের! আপনি বলুন তো ইটের জবাব কী ভাবে দেওয়া উচিত?”
নিজের প্রশ্নের জবাবটাও মহেন্দ্র নিজেই দিয়েছিলেন। শান্ত অথচ কঠোর গলায় বস্তারের আদিবাসী কংগ্রেস নেতা বলেছিলেন, “মাওবাদীদের বুলেটের জবাব কী ভাবে দিতে হয় তা আমাদের জানা আছে।”
কিন্তু এই সালওয়া জুড়ুম আন্দোলনের নামে কি আদিবাসীদেরই আদিবাসীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে না? “একেবারেই হচ্ছে না। যে আদিবাসীরা নকশালবাদের নামে অন্য আদিবাসীদের উপরে অত্যাচার চালায়, এই আন্দোলনে অসুবিধা হচ্ছে তাঁদের ও তাঁদের মদতদাতাদের।” মহেন্দ্র কর্মার উত্তর ছিল এ রকমই নির্বিকার।
বস্তুত এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি মহেন্দ্র বহু বার হয়েছেন। তাঁকে বলা হত ‘টাইগার অফ বস্তার’। বস্তারের বাঘ! তাঁর একরোখা মনোভাব, মাওবাদীদের বিরুদ্ধে একেবারে সামনে থেকে লড়াই চালানো সব মিলিয়ে বস্তার তাঁকে এই উপাধি দিয়েছিল। |
|
এই উপাধির সঙ্গেই মিশ খায় তাঁর সেই উক্তি, “মাওবাদীদের বুলেটের জবাব কী ভাবে দিতে হয় তা আমাদের জানা আছে।”
অথচ সেই মাওবাদী বুলেটই প্রাণ কেড়ে নিল তাঁর। শুধু কাড়লই না, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, মৃত্যুর আগে তীব্রতম যন্ত্রণা পান, সেটা নিশ্চিত করেছিল মাওবাদীদের মহিলা সদস্যরা। মহেন্দ্রর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বলছে, তাঁর শরীরে ছুরির অন্তত ৭৫টি আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। মাওবাদীদের আক্রোশ এতটাই তীব্র ছিল যে, তাঁর মৃতদেহ ঘিরে উল্লাসে নেচেছিল তারা।
গত কাল হামলার দায় স্বীকার করে যে প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করেছে মাওবাদীরা, তারও সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে মহেন্দ্র কর্মার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। কারণ ২০০৫ সালে সালওয়া জুড়ুম শুরুর বছর থেকেই মাওবাদীদের খতম তালিকার পয়লা নম্বর নাম মহেন্দ্র কর্মা। সকলেই জানতেন, এই সালওয়া জুড়ুম-এর হোতা তিনিই। বিজাপুর ও দন্তেওয়াড়া জেলায় মোট ৯টি সালওয়া জুড়ুম ক্যাম্প খুলে, ছ’শোরও বেশি আদিবাসী গ্রাম খালি করিয়ে হাজার হাজার আদিবাসীকে ওই সব ক্যাম্পে রেখে তাঁদের সামনে সশস্ত্র পাহারা বসিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, তাঁরও নাম মহেন্দ্র কর্মা।
এই পাহারায় কারা ছিল? ছিল দন্তেওয়াড়া, বিজাপুর, সুকমার ১৬ থেকে ২৫-২৬ বছরের কিশোর-তরুণেরা। সরকারি টাকায় তাদের বেতন হয়। সামান্য পুলিশি প্রশিক্ষণ দিয়েই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হত ইনসাস, স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র। তাদের পোশাকি নাম ছিল ‘স্পেশাল পুলিশ অফিসার’ (এসপিও)। ইউনিফর্ম পরা এই এসপিও-দের নিয়ে এখনও মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানে যায় পুলিশ এবং সিআরপিএফ। ভূমিপুত্র হওয়ার সুবাদে এলাকার মানচিত্র এবং মাওবাদীদের হাতের তালুর মতো চেনে এই এসপিও-রা। যদিও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে এই এসপিও-দের পোশাকি নাম এখন অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্স। খাতায়-কলমে এখন এসপিও-র কোনও অস্তিত্ব নেই।
মনে আছে, এক বার দন্তেওয়াড়ার এক সালওয়া জুড়ুম ক্যাম্পে ঢোকার সময় চার দিক থেকে উদ্যত ইনসাস রাইফেলের সামনে পড়ে মহেন্দ্র কর্মার নাম বলায় ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছিল। নিমেষে সশস্ত্র এসপিও-দের উদ্ধত ভাষা বদলে গিয়েছিল বন্ধুতায়।
কিন্তু বিতর্ক কোনও দিনই পিছু ছাড়েনি মহেন্দ্রর। এক সময়ে সিপিআইয়ের সর্বসময়ের কর্মী মহেন্দ্রর বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে আদিবাসীদের বিরুদ্ধাচরণ করার অভিযোগ। বস্তারের অত্যন্ত প্রভাবশালী সিপিআই নেতা মণীশ কুঞ্জম যেমন বললেন, “আমাদের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ দিন কাজ করলেও তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে তীব্র মতভেদ ছিল আমাদের। সালওয়া জুড়ুম ছাড়াও আদিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনে বাধা দেওয়ার জন্য বরাবর ষষ্ঠ তফসিলের বিরোধিতা করেছেন তিনি। মহেন্দ্র কর্মা দীর্ঘ দিন ধরে আদিবাসীদের নিয়ে রাজনীতি করেছেন বটে, কিন্তু তা আদিবাসীদের জন্য নয়।” সুকমার তৎকালীন জেলাশাসক অ্যালেক্স পল মেননকে অপহরণের পরে তাঁর ওষুধ ও জামাকাপড় পৌঁছে দেওয়ার জন্য মাওবাদীরা প্রথম অনুমতি দিয়েছিল এই মণীশ কুঞ্জমকেই।
রাজনৈতিক বিরোধিতার কথা বললেও মণীশ অবশ্য মহেন্দ্র-হত্যার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁর কথায়, “এ ভাবে কাউকে মারার অধিকার কারও নেই। রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজনীতি দিয়েই করতে হবে। আমি সরকারি বা বেসরকারি, কোনও হিংসাই সমর্থন করি না।”
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সেই ১৯৯০ সাল থেকেই লড়ছিলেন মহেন্দ্র কর্মা। তখন অবশ্য সেই আন্দোলনের নাম ছিল ‘জনজাগরণ অভিযান’। আর ২০১৩-র ২৫ মে মাওবাদীরা যখন নামের তালিকা এনে তাঁকে খুঁজল, তখনও গাড়ি থেকে নেমে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ৬২ বছরের আদিবাসী নেতা। বললেন, “আমিই মহেন্দ্র কর্মা। আমার সঙ্গে তোমাদের শত্রুতা থাকলে আমাকে নিয়ে চলো। ওদের ছেড়ে দাও।”
মাওবাদী বুলেট ছাড়েনি তাঁকে। রণাঙ্গনের নিয়মেই এক পক্ষকে ভূমি নিতে হয়েছে!
জল-জঙ্গল-পাহাড়ে ঘেরা বস্তারের অভয়ারণ্য তাই আপাতত ব্যাঘ্রহীন!
|
পুরনো খবর: কিছুটা এগিয়েই বুঝলাম, মহেন্দ্র কর্মাকে মারল ওরা |
|
|
|
|
|