|
|
|
|
কিছুটা এগিয়েই বুঝলাম, মহেন্দ্র কর্মাকে মারল ওরা |
তাপস সিংহ • রায়পুর |
গুলি লেগেছে, কিন্তু আঘাত গুরুতর নয়। ওই অবস্থাতেই গাড়িতে তুলে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ! উদ্যত অগুন্তি কালাশনিকভের নির্দেশ মেনে গাড়িতে কয়েক মিটার এগোতেই কানে এল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির শব্দ। বুঝতে পারলেন, মহেন্দ্র কর্মাকে মেরে ফেলল ওরা।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ৪৮ ঘণ্টা পরেও আতঙ্কে কেঁপে উঠছিলেন সে দিনের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ কাওয়াসি লখমা। বস্তার ডিভিশনের ১২টি বিধানসভা কেন্দ্রের একমাত্র কংগ্রেস বিধায়ক। শনিবার কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় মাওবাদী তাণ্ডব থেকে যে কয়েক জন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন, তাঁদের অন্যতম। |
|
নিহত প্রদেশ সভাপতি নন্দকুমার পটেলের শোকসভায়
সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। সোমবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই |
কী হয়েছিল সে দিন?
লখমা জানান, সুকমায় কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন যাত্রা’ শেষে ১৬টি গাড়ির কনভয় শনিবার জগদলপুরে ফেরার জন্য ওই পথে ঢোকে বিকেল চারটে নাগাদ। তার কয়েক ঘণ্টা আগেই বেলা ১১টা নাগাদ সিআরপিএফের ‘রোড ওপেনিং পার্টি’ দরভার জিরম পাহাড়ের রাস্তার দু’ধার দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। চার দিক শান্ত। অস্বাভাবিক কিছু তখনও চোখে পড়েনি। কিন্তু বিকেল চারটে নাগাদ যখন কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের নিয়ে কনভয় ওই রাস্তায় ঢুকল, তার বহু আগেই দরভা পাহাড়ের পাকদণ্ডীর আড়ালে ‘পজিশন’ নিয়ে নিয়েছে সশস্ত্র মাওবাদীরা। টোংপাল ও দরভার মাঝখানে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার রাস্তার পাশের ঘন জঙ্গলের আড়ালে ও নীচের উপত্যকার গা ঘেঁষে একে-৪৭, ইনসাস ও কালাশনিকভ নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে এক দল কমবয়সী ছেলেমেয়ে। ওই রাস্তার উপরেই একটি ‘খারাপ’ ট্রাক আড়াআড়ি ভাবে দাঁড় করানো। ট্রাকটির জন্য রাস্তা পুরো বন্ধ না হলেও যে কোনও গাড়িকেই ওই জায়গা পার করতে হলে গতি কমাতে হবে। তখনও কেউ জানেন না, ট্রাকের চালকের কেবিনে পড়ে রয়েছে চালক ও খালাসির গুলিবিদ্ধ দেহ।
কিছুটা এগোলেই কালভার্ট। কনভয়ের গাড়িগুলি সেই কালভার্ট অবধি যাওয়ার আগেই শুরু হল উপর ও নীচ থেকে নির্বিচার গুলিবর্ষণ। গাড়ির গতি কম থাকলেও গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম দু’টি গাড়ি কোনও রকমে কালভার্ট পেরিয়ে পালিয়ে যায়। প্রথম গাড়িতে ছিলেন কংগ্রেস কর্মীরা। দ্বিতীয় গাড়িতে জগদলপুরের কংগ্রেস নেতা অবধেশ গৌতম। কিন্তু আটকে গেল তিন নম্বর গাড়িটাই। তাতেই ছিলেন ছত্তীসগঢ় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নন্দকুমার পটেল, তাঁর ছেলে দীনেশ ও কাওয়াসি লখমা। এর পরেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে গেল কিছুটা দূরে থাকা কনভয়ের চতুর্থ গাড়িটি। ছিটকে পড়ল ওই গাড়ির চার জনের দেহ।
কাওয়াসি বলেছেন, “ওই অবস্থায় মাওবাদীরা আমাদের কাছে এসে গাড়ি থেকে নামিয়ে জিগ্যেস করে, নন্দকুমার পটেল কোন জন? আমাদের টেনে নামিয়ে বেশ কিছুটা হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। আমি গোন্ডি ভাষায় ওদের মিনতি করে বলি, পরিবর্তন যাত্রায় সামিল কংগ্রেস নেতাদের ছেড়ে দাও। ওরা তখন আমায় আবার গাড়িতে বসিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। কিছুটা যাওয়ার পরেই টের পাই, ওরা মহেন্দ্র কর্মাকে মেরে ফেলেছে। নন্দকুমার ও তাঁর ছেলেকে টেনে নিয়ে গিয়েছে।”
শুধু মহেন্দ্র কর্মা বা নন্দকুমার নন, সব মিলিয়ে ২৪ জনকে সেই বিকেলে গুলি চালিয়ে খুন করেছিল মাওবাদীরা। কিন্তু তাদের হাতে ধরা পড়েও লখমা
কী ভাবে ছাড়া পেলেন? সে প্রশ্ন উঠতে শুরুছে নানা মহলে। অনেকেই মনে করছেন, কাওয়াসি আগাগোড়াই মাওবাদীদের আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরব হয়েছেন। তা ছাড়া তিনি মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন আদিবাসী নেতা। তাই এ যাত্রায় রেহাই পেয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত বলছে, মাওবাদীদের হাতে কংগ্রেস নেতাদের নামের তালিকা ছিল। তারা মহেন্দ্র কর্মা কোথায় তা জানতে চাইছিল। ‘সালওয়া জুড়ুম’-এর হোতাকে রাজ্য সরকার জেড প্লাস নিরাপত্তা দেয়। নিজের বুলেট প্রুফ গাড়ি থেকে নেমে মহেন্দ্র হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করেন। দৌড়ে এসে মাওবাদীরা তাঁকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। পরে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরে তীব্র আক্রোশে তাঁর গায়ে লাথি মারতে থাকে মাওবাদীরা। কয়েক জন তাঁর দেহ ঘিরে নাচতে থাকে।
কিন্তু এ রকম যে ঘটতে পারে, তার আগাম খবর কি গোয়েন্দাদের কাছে ছিল না?
রাজ্য গোয়েন্দা দফতর সূত্রে কিন্তু ভিন্ন তথ্য মিলছে। জানা গিয়েছে, সন্ত্রাস কবলিত সুকমা জেলার ওই দরভা পাহাড় এলাকায় যে মাওবাদী হামলা হতে পারে, সে ব্যাপারে গোয়েন্দাদের আগাম সতর্কতা ছিল। সিআরপিএফের কাছেও সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। চলতি মে মাসেই বেশ কয়েকটি গোপন রিপোর্টে গোয়েন্দারা সতর্ক করে দেন, বস্তারের বিভিন্ন এলাকায় ‘বিকাশ যাত্রা’ ও ‘পরিবর্তন যাত্রা’র বিরুদ্ধে মাওবাদীরা জনমত সংগঠিত করছে। তারা টোংপাল ও দরভায় হামলা চালানোর ছক কষছে। কিন্তু ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি!
কেন? সে উত্তর কার্যত এড়িয়ে গিয়ে রাজ্য পুলিশের কর্তারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, ওই রকম দুর্গম এলাকায় পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া কতটা কঠিন! মাওবাদী দমন অভিযানের ভারপ্রাপ্ত ছত্তীসগঢ় পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল আর কে ভিজ যেমন আজ আনন্দবাজারকে বললেন, “ওই রকম একটা ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি পথে এ রকম অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু তার জন্য মাওবাদী দমন অভিযান বন্ধ থাকবে না।” একই ভাবে পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল (গোয়েন্দা শাখা) মুকেশ গুপ্ত বললেন, “পৃথিবীর কোনও বাহিনীর পক্ষেই ১০০% নিরাপত্তা দেওয়া যায় না।”
এর মধ্যেই সিআরপি কর্তারা বিতর্ক বাড়িয়ে জানিয়েছেন, ‘পরিবর্তন যাত্রা’ যাওয়ার সময় তাঁরা সাহায্য করলেও ফেরার সময় তাঁদের উপযুক্ত সাহায্য চাওয়াই হয়নি। সিআরপিএফের আইজি (অপারেশনস) জুলফিকার হাসান শুধু বললেন, “থানা স্তর থেকে যতটুকু লোক চাওয়া হয়েছিল, ততটুকুই দেওয়া হয়েছে। এর বেশি লোক চাইলে তা-ও দেওয়া হত।”
সন্ত্রাস আর বিতর্ক এই ছত্তীসগঢ়ে দু’টিই পাল্লা দিয়ে চলে! ২৪টি প্রাণের বিনিময়েও!
|
পুরনো খবর: হামলার পরে মহেন্দ্র কর্মার দেহ ঘিরে নাচ মাওবাদীদের |
|
|
|
|
|