আশানুরূপ যাত্রী না-পাওয়ায় কলকাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে প্রথম সারির তিন বিদেশি বিমান সংস্থা। এবং সেই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, লুফৎহানসা ও কেএলএম খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের আহ্বানেও মুখ ফিরিয়ে রইল। আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও ওই ৩ বিমান সংস্থার কোনও প্রতিনিধি বুধবার মহাকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা আলোচনায় যোগ দিতে আসেননি।
কেন কলকাতা থেকে আরও বেশি বিমান চালানো উচিত, তা ব্যাখ্যা করতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিমান সংস্থাকে এ দিন ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বিদেশি সংস্থাগুলির মধ্যে বৈঠকে মূলত তারাই হাজির হয়েছিল, যারা এখন কলকাতা থেকে উড়ান চালায়। এর বাইরে বলতে ছিল দু’টি এয়ার আরাবিয়া ও তুরস্কের বিমান সংস্থা। তাদের প্রতিনিধিরা জানিয়ে গিয়েছেন, কলকাতা থেকে উড়ান চালুর বিষয়টি নির্ভর করছে কেন্দ্রীয় সরকারের মতামতের উপরে।
তবে কলকাতা তথা রাজ্যের প্রাপ্তি যে একেবারেই কিছু হয়নি, তা নয়। যেমন ইনডিগো-র সিইও আদিত্য ঘোষ বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন, তাঁরা কলকাতা থেকে সরাসরি গোয়া, পুণে, রাঁচিতে উড়ান চালাবেন। রাজ্যে আরও বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনার কথা শোনা গিয়েছে বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বেদপ্রকাশ অগ্রবালের মুখে। ভারতে বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিরেক্টোরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশনের (ডিজিসিএ) প্রধান অরুণ মিশ্র জানান, আগামী ক’মাসের মধ্যে বাগডোগরায় রাতে বিমান ওঠা-নামার বন্দোবস্ত হবে। |
বস্তুত এ দিনের বৈঠকে রাজ্যের পাওনা বলতে এটুকুই। উল্টো দিকে এক বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি মহাকরণ ছাড়ার সময়ে পরিষ্কার জানিয়ে গিয়েছেন, কলকাতায় উচ্চ শ্রেণির আসনের বিশেষ যাত্রী পাওয়া যায় না। তাই বিভিন্ন বিমান সংস্থা এখানে উড়ান চালাতে আগ্রহ বোধ করছে না। এ দিন রাজ্যের তরফে পেশ করা তথ্যাদি দেখেও এ ব্যাপারে তেমন আশাবাদী হতে পারেননি বিদেশি বিমান সংস্থাটির ওই প্রতিনিধি। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, লুফৎহানসা
বা কেএলএমের-ও কেউ এলেন না কেন?
রাজ্যের পর্যটন-সচিব বিক্রম সেনের ব্যাখ্যা: পূর্ব নির্ধারিত কাজ থাকায় তিন সংস্থার প্রতিনিধিরা আসতে পারেননি। তবে তিন মাস পরে ফের মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে তিন সংস্থাই হাজির থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন বিক্রমবাবু। এ দিন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও লুফৎহানসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা অবশ্য এ প্রসঙ্গে এখনই মন্তব্য করতে চাননি।
কী হল এ দিনের বৈঠকে?
প্রশাসনিক সূত্রের খবর: প্রথম পৌনে এক ঘণ্টায় মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়ন-চিত্র তুলে ধরেন বিমান-প্রতিনিধিদের সামনে। মমতা দাবি করেন, কৃষি-পর্যটন-পরিকাঠামোর পাশাপাশি শিল্পেও পশ্চিমবঙ্গ এখন দেশের মধ্যে প্রথম। রাজ্যের পর্যটন-সম্ভাবনা প্রসঙ্গে (পর্যটনমন্ত্রী অবশ্য বৈঠকে ছিলেন না) দিঘা-সুন্দরবন-মন্দারমণি-দার্জিলিঙের মতো বিভিন্ন জায়গায় উড়ান ও হেলিকপ্টার-পরিষেবা চালু করায় উৎসাহ দেখিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু উপস্থিত প্রতিনিধিদের অনেকেই বৈঠক সেরে বেরিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে যদি শিল্পের এত প্রসার হয়ে থাকে, তা হলে দিল্লি-মুম্বইয়ের তুলনায় উড়ান এখাএত কম কেন? কেনই বা উচ্চ শ্রেণির আসনে যাত্রীর অভাব?”
এবং বৈঠকে যে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির জবাব মেলেনি, তা ওঁদের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। উপরন্তু এ রাজ্যে জ্বালানি-করের বাড়তি হার নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। তাঁদের বক্তব্য: পশ্চিমবঙ্গ ২৪% হারে জ্বালানি-কর আদায় করে, অধিকাংশ রাজ্যের তুলনায় যা বেশি। কিছু সংস্থার প্রতিনিধি বৈঠকে জানিয়ে দিয়েছেন, এটা না-কমালে কলকাতায় বাড়তি উড়ান চালাতে সমস্যা হবে। মহাকরণ-সূত্রের খবর: বৈঠকে এক প্রতিনিধি অন্ধ্রের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ওখানে জ্বালানি-কর মাত্র ৪%। মুখ্যমন্ত্রীর জবাব ছিল, “ওখানে কংগ্রেস সরকার চালায়। তাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না।” কেন্দ্র যাতে তাদের জ্বালানি-কর কমায়, সে জন্য বিমান সংস্থাগুলোকে দিল্লিতে দরবার করার পরামর্শও দেন মমতা।
সব মিলিয়ে সমস্যাটির সুরাহার কোনও আশ্বাস বৈঠকে মেলেনি বলে বিদেশি বিমান সংস্থার প্রতিনিধিদের একাংশের দাবি। তাঁরা বিশেষ ভরসাও পাচ্ছেন না। “গত চৌত্রিশ বছর ধরে কী ভাবে এ রাজ্যে অপশাসন চলেছে, এবং কত অন্যায় ভাবে রাজ্যের ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপানো হয়েছে, সে সব আমরা শুনলাম। দিল্লির বঞ্চনার কথা জানলাম। বুঝলাম, রাজ্যের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, জ্বালানি-কর কমানো যাবে না।” হতাশ মন্তব্য এক প্রতিনিধির। আর এক বিদেশি সংস্থার কর্তার আক্ষেপ, “রাজনীতির কথা শুনে আমরা কী করব? জ্বালানি-কর না-কমালে আমাদের চলবে কী করে?”
এ হেন প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে রাজ্য সরকারের কী বক্তব্য?
বৈঠক শেষে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, “যাঁরা উড়ান চালু করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, তাঁরা করের পরিমাণ জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” অমিতবাবুর দাবি: এয়ার আরাবিয়া ও তুরস্কের বিমান সংস্থা কলকাতায় উড়ান চালাতে আগ্রহী। যদিও দুই সংস্থার প্রতিনিধিরা এ দিন জানান, এই মুহূর্তে তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। তাঁদের দেশের সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক ভারতে আরও বেশি উড়ান চালানোর অনুমতি পেলেই তা ভাবা যাবে।
সে চুক্তি হবে কি না, সেটা অবশ্য পুরোপুরি দিল্লির হাতে।
|