পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজ-খবর করতে রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের আজ, মঙ্গলবার রাজভবনে বৈঠকে ডেকেছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। এতে বেজায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রশ্ন, পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতির ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভাবে সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন। রাজ্যপাল কোন অধিকারে সরকারি কর্তাদের ডেকে পাঠিয়ে প্রস্তুতি-বৈঠক করতে পারেন? এর আগে ভোট-প্রস্তুতি নিয়ে কোনও রাজ্যপাল এ ধরনের বৈঠক ডেকেছেন বলে সরকারি কর্তাদেরও মনে পড়ছে না।
এবং বর্তমান রাজ্যপালের এ হেন আচরণে মুখ্যমন্ত্রী এতটাই ক্ষুব্ধ যে, তিনি সরাসরি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে এ বিষয়ে নালিশ জানানোর কথা ভাবছেন বলে প্রশাসনিক সূত্রের ইঙ্গিত। এ প্রসঙ্গে ঘনিষ্ট মহলে মমতার মন্তব্য, “প্রণবদাকে বলব, রাজ্যপালকে দিয়ে আপনি-ই সরকার চালান। আমাদের আর দরকার কী?” রাজভবন অবশ্য এই বৈঠক-উদ্যোগে ব্যতিক্রমী কিছু দেখছে না। তাদের যুক্তি কী?
রাজভবন-সূত্রের বক্তব্য: অতীতেও বহু বার রাজ্যপাল সরকারি প্রতিনিধিদের ডেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন, এতে নতুনত্ব কিছু নেই। তা ছাড়া রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ভোট-প্রস্তুতির পুঙ্খানুপুঙ্খ রাজভবনে জানিয়ে গিয়েছেন। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রাজ্যপালের দায়িত্ব হল, কমিশনের যাবতীয় উদ্বেগ সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা। আবার তিনি যে হেতু সরকারেরও প্রধান, তাই তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভোট প্রস্তুতির বিষয়টি জানতে চাইতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে সেটাই তিনি করছেন বলে রাজভবন-সূত্রের দাবি।
তবে রাজ্যপালের বিশেষ সচিব ডি কে গৌতম যে ভাবে চিঠি লিখে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র-সচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং রাজ্য গোয়েন্দা-প্রধানকে ডেকে পাঠিয়েছেন, তাকে এক কথায় ‘নজিরবিহীন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন সরকারি কর্তাদের একাংশ। যদিও ডিজি ছুটিতে থাকায় যেতে পারছেন না। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য কর্তাদের যেতে নিষেধ করেননি। বরং ঘনিষ্ঠ মহলে মমতা বলেছেন, “রাজ্যপালের পদের গরিমা রয়েছে। তা নষ্ট করতে চাই না। অফিসারেরা রাজভবনে গিয়ে প্রস্তুতি জানিয়ে আসবেন।” প্রসঙ্গত, রাজ্যপালের বৈঠকের নির্ধারিত সময় বেলা বারোটা। এ দিকে রাজভবনে তলব পাওয়া অফিসারদের বেলা একটায় বৈঠকে ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী। অনেকের ধারণা, রাজ্যপাল যাতে ওঁদের দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখতে না-পারেন, সেই উদ্দেশ্যেই মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে বৈঠক ডেকে দিলেন।
রাজ্যপাল বৈঠক ডাকায় মুখ্যমন্ত্রীর এতটা উষ্মার কারণ কী?
সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা: হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করে দিয়েছে। তার পরেও আদালত-নির্দেশিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে রাজ্যপালকে জানিয়ে এসেছেন, ভোটে মনোনয়নপর্ব থেকেই গোলমাল হতে পারে। হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আসতে শুরুও করেছে। অথচ বাড়তি বাহিনী কোথা থেকে আসবে, রাজ্য এখনও তা জানিয়ে উঠতে পারেনি। সরকারি সূত্রের খবর: আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে বিভিন্ন সূত্র মারফত এমন একটা আঁচ রাজ্যপাল নিজেও পেয়েছেন। বিরোধীরাও এই মর্মে তাঁর কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে এসেছেন। পাশাপাশি কমিশন তাঁকে জানিয়েছে, মনোনয়নপর্বেই বহু আসন একতরফা জিতে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন সূত্রে তাদের কানে এসেছে।
রাজ্যপালের বৈঠক আহ্বানের পিছনে এ হেন পরিস্থিতিকেই প্রেক্ষাপট হিসেবে বর্ণনা করছে সরকারি মহলের একাংশ। কিন্তু ঘটনা হল, বৈঠকে নারায়ণন যে বিষয়গুলো জানতে চাইতে পারেন, সরকারি প্রতিনিধিদের কাছে তার যুতসই জবাব নেই। তাই আজকের বৈঠক নিয়ে মহাকরণ কিছুটা অস্বস্তিতেই রয়েছে। কী রকম?
এক সরকারি কর্তার কথায়, “রাজ্যপাল মনোনয়নপর্বে নিরাপত্তার ব্যবস্থা জানতে চাইলে বলার মতো কিছু নেই।” তাঁর ব্যাখ্যা: হাওড়া লোকসভা ভোটের জন্য প্রায় ৫০ কোম্পানি রাজ্য পুলিশ দেওয়া হয়েছে। ৮ কোম্পানি যাচ্ছে কলকাতা পুলিশ থেকে। ফলে পঞ্চায়েতের মনোনয়নপত্র পেশের প্রথম পর্বে (২৯ জুন-৫ জুলাই) ২১০টি ব্লকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করে ওঠা যায়নি। এক বার ঠিক হয়েছিল, বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে বাহিনী তুলে ওই ২১০টি ব্লকে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু ছত্তীসশগঢ়ের ঘটনার পরে জঙ্গলমহল বা উত্তরবঙ্গের কেএলও-প্রভাবিত এলাকায় বসানো সুরক্ষা-ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। আবার বিভিন্ন জেলায় রাজনৈতিক অশান্তির জেরে চালু হওয়া ক্যাম্পগুলোও তোলা যাচ্ছে না। ফলে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নপর্বে পর্যাপ্ত বাহিনী মোতায়েন করাটা স্বরাষ্ট্র দফতরের পক্ষে কার্যত অসম্ভব বলে ওই অফিসারের দাবি। তাই সংশয়, পঞ্চায়েত নির্বাচনের নিরাপত্তা-আয়োজন সম্পর্কে রাজ্য সরকার আদালতে যে হলফনামা দিয়েছিল, মহাকরণ তা পূরণ করতে পারবে কি?
রাজ্যপালও প্রশ্নটি তুললে জবাব কী হবে, প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিরা তা ভেবে পাচ্ছেন না। রাজভবনের চিঠিতে অবশ্য ভোটপর্বের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই। তবু প্রশাসন আশঙ্কায়। “পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি পর্যালোচনায় প্রধান আলোচ্য তো আইন-শৃঙ্খলাই!” মন্তব্য এক সরকারি আধিকারিকের। আর এরই সূত্রে তাঁর বিশ্লেষণ: আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে সরকারের এক্তিয়ারে রাজ্যপাল নাক গলানোর চেষ্টা করছেন ভেবেই মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
|