রাজ্যেও নেতা-হত্যায় নামতে পারে মাওবাদীরা
তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার গলায় একরাশ উৎকণ্ঠা। দিল্লি থেকে সোমবার ফোনে বললেন, “যা হয়ে গেল সুকমায়! আমাদের তো সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। জঙ্গলমহলের অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় প্রচারে যেতে হবে। ওই সব এলাকায় লোকসভা, বিধানসভার প্রচারে হয়তো না ঢুকলেও চলে। কিন্তু পঞ্চায়েতে তো বাদ দেওয়া যাবে না। তবে ছত্তীসগঢ়ের ঘটনার পর বুঝতে পারছি না, কী করব!”
পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা জঙ্গলমহলে গত দেড় বছর হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ থাকলেও আশঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি। ঝুঁকি সব সময়েই ওই এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলির, বিশেষ করে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী-কর্মী ও নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গী। কিন্তু সুকমায় এক লহমায় ছত্তীসগঢ়ের কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বকে মাওবাদীরা নিকেশ করে দেওয়ার পরে সেই আশঙ্কা যে কার্যত কাঁপন ধরিয়েছে, তৃণমূলের ওই ডাকাবুকো নেতার কথাতেই তা স্পষ্ট। কাঁপন যেন আরও বাড়িয়ে দিতেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এ রাজ্যেও শাসক দলের নেতাদের খুন করার ছক কষছে মাওবাদীরা।
আর সে কথা মাথায় রেখেই এই রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে জঙ্গলমহলে নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়কদের নিরাপত্তা ঢেলে সাজার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। চলতি সপ্তাহেই বৈঠকে বসছেন রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তারা। ঘটনাচক্রে সুকমায় হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই পুরুলিয়ার বলরামপুর ব্লকের অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন ঘাটবেড়া-কেরোয়া এলাকায় পড়েছে মাওবাদী-পোস্টার।
রাজ্যের নিরাপত্তা অধিকর্তা বীরেন্দ্র বলেন, “ছত্তীসগঢ়ের সাম্প্রতিক ঘটনার কথা মাথায় রেখে জঙ্গলমহলে নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদদের নিরাপত্তায় কিছু বদল আনছি। জঙ্গলমহলে তাঁদের সফর থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কর্মসূচি, সব বিষয়েই নজর রেখে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হবে।” স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, জঙ্গলমহলে তৃণমূলের সাংসদ ও বিধায়কেরা ছাড়াও দু’শোরও বেশি স্থানীয় তৃণমূল নেতা এখন সরকারি নিরাপত্তা পাচ্ছেন। তাঁদের কাউকে কাউকে চার জন নিরাপত্তারক্ষীও দেওয়া হয়েছে।
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, জঙ্গলমহলে তৃণমূলের কয়েক জন নেতা-মন্ত্রী ও সাংসদের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনার কথা বলা হবে। পুলিশের পরামর্শ মেনে সফরসূচি স্থির করতে তাঁদের অনুরোধ করা হবে।
রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল (আইনশৃঙ্খলা) বাণীব্রত বসুর বক্তব্য, “আর ক’দিনের মধ্যেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচার শুরু হবে। জঙ্গলমহলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রচারের সময়ে এ বার সুকমায় মাওবাদী হামলার জেরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও অনেক জোরদার করা হবে।” এডিজি আরও বলেন, “পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারের ক্ষেত্রে জঙ্গলমহলে রাজনৈতিক দলগুলির কী করণীয় আর কী নয়, সেটা আমরা ঠিক করব। দলগুলিকে সেই অনুযায়ী চলতে হবে। সকলের নিরাপত্তার স্বার্থেই এ কথা বলা হচ্ছে।” প্রাথমিক ভাবে যেটা ঠিক হয়েছে, নিজেদের খুশি মতো কনভয়ের যাত্রাপথ বদল, প্রত্যন্ত এলাকা দিয়ে একই কনভয়ে এক সঙ্গে বেশ কয়েক জন নেতা-মন্ত্রীর যাতায়াত, কাঁচা সড়ক বা মোরাম রাস্তায় তল্লাশি ছাড়া সফর পুলিশ এ বার কিছুতেই এ সবের অনুমতি দেবে না। আসলে শুধু ছত্তীসগঢ় নয়, দেড় বছর চুপচাপ থাকার পর নিজেদের শক্তি ও উপস্থিতি জাহির করতে মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে ফের হিংসার পথ ধরতে চলেছে বলে জেনেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তবে তাঁদের দাবি, এ বার মাওবাদী হিংসার ধরন ও লক্ষ্যদুই-ই হবে নতুন ধরনের। গোয়েন্দাদের দাবি, হিংসার ধরন ও লক্ষ্য লালগড় আন্দোলনের সময়ের তুলনায় অনেকটাই আলাদা হবে। নির্বিচার গণহত্যার বদলে তৃণমূলের বাছাই করা স্থানীয় নেতারাই এ বার তাদের মূল ‘টার্গেট’। সুকমার হামলা ওই গোয়েন্দা-তথ্যকেই অনেকটা নিশ্চিত ও প্রতিষ্ঠিত করল বলে পুলিশকর্তাদের অভিমত।
সুকমার হামলার কিছু দিন আগেই কলকাতায় সাবসিডিয়ারি মাল্টি এজেন্সি সেন্টার (স্ম্যাক)-এর সাম্প্রতিক বৈঠকে মাওবাদী হামলার ওই নতুন কৌশলের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন পুলিশ, নিরাপত্তাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে তাদের পাওয়া তথ্য মূল্যায়ন করে স্ম্যাক। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসআইবি, রাজ্য গোয়েন্দা শাখা, কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) এবং সিআরপি-র প্রতিনিধিরা স্ম্যাক-এর ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
কী রকম হতে পারে মাওবাদীদের নতুন হামলার ধরন? কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, প্রথমে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কোনও কনভয়ের উপর আঘাত হানতে পারে মাওবাদীরা। এটা মাওবাদীদের পরিকল্পিত নতুন ধরনের হামলার প্রথম ধাপ। ওই হামলা আসলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, এই ধরনের হামলায় সাফল্য এলে যৌথবাহিনীর প্রত্যন্ত এলাকাতেও অবাধে ঢোকা এবং প্রায় সব জায়গায় রাজনৈতিক ও উন্নয়নের কার্যকলাপ চলার গতি থমকে যাবে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, তার পর মূলত তৃণমূলের ব্লক পর্যায়ের নেতারা মাওবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারেন। বিশেষ করে এলাকায় যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দাদাগিরির অভিযোগ উঠেছে অথবা সাধারণ মানুষ যাঁদের উপর ক্ষুব্ধ।
তবে পুলিশের চর সন্দেহে কোনও সাধারণ মানুষ কিংবা রাজনৈতিক দলের একেবারে তৃণমূল স্তরের কর্মী বা সমর্থককে জঙ্গলমহলে আর হত্যা না করার সিদ্ধান্ত মাওবাদীরা নিয়েছে বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। কারণ, সে রকম করলে আবারও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১১—এই চার বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায় পাঁচশোরও বেশি মানুষ মাওবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন। ব্লক পর্যায়ের তৃণমূল নেতারা ছাড়াও জঙ্গলমহলের লাগোয়া একটি জেলার এক তৃণমূল সাংসদ তো মাওবাদীদের খতমের তালিকায় রয়েছেনই। অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগরে কিছু দিন আগেই মাওবাদীদের এক সভায় ওই সাংসদকে ‘টার্গেট’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

নিরাপত্তা চায় প্রদেশ কংগ্রেস
ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী হামলা হয়েছে ভোটের ক’মাস আগে। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতারা তাই এ রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের আগে মাওবাদী হামলার আশঙ্কাকে হাল্কা ভাবে নিচ্ছেন না। প্রদেশ কংগ্রেস এ রাজ্যেও বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য প্রশাসনের কাছে আর্জি জানিয়েছে। জঙ্গলমহলের তিন জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া এবং পার্শ্ববর্তী পূর্ব মেদিনীপুরে দলের নেতা ও প্রার্থীদের জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করার আর্জি জানিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে সোমবার চিঠি পাঠিয়েছেন দলের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব। একই দাবি জানিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডেকে চিঠি দিয়েছেন মানস ভুঁইয়াও।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.