জীবন প্রতি মূহূর্তেই পরীক্ষা নেয় ওদের। হয়তো সেই কারণেই মাধ্যমিক পরীক্ষাটা ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে উঠতে পারেনি সাইবা, ঋতেশ, মুন্নাদের সামনে। সমাজের প্রায় প্রান্ত পল্লির এই বাসিন্দাদের কেউ দৃষ্টিহীন, কেউ দিন গুজরানের জন্য শালপাতা কুড়োয়, চাষ করে। মাধ্যমিকে ওদের অনেকেরই সংগ্রহে ৮০-৮৩ শতাংশ নম্বর।
দৃষ্টিহীনতাকে জয় করে এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে রামকৃষ্ণ সারদামণি বিদ্যাপীঠের ছাত্রী সাইবা কুজুর। চারটি বিষয়ে ৮০ শতাংশের উপর নম্বর পেয়েছে সে। মোট নম্বর ৫৪২। ছোটবেলায় টাইফয়েডে দু’চোখেরই দৃষ্টি হারিয়েছে সাইবা। বাবা বুধুরামবাবু বাগডোগরা এলাকায় গঙ্গারাম চা বাগানের শ্রমিক। একই সঙ্গে দৃষ্টিহীনতা এবং দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই সাইবার। শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি প্রতিবন্ধী স্কুল থেকে ব্রেল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করার পর সে রামকৃষ্ণ সারদামণি বিদ্যাপীঠে ভর্তি হয় পঞ্চম শ্রেণিতে। নিজের নম্বর জানার পরে তার প্রতিক্রিয়া, “এই ফলে আমি খুশি।” একাদশ শ্রেণিতে বাগডোগরা চিত্তরঞ্জন হাইস্কুলে ভর্তি হবে সাইবা। ভবিষ্যতে সে আইন নিয়ে পড়তে চায়। |
সাইবা কুজুর |
সৌরভ জানা |
অভিজিৎ মাইতি |
|
কোচবিহার টাউন স্কুলের ছাত্র অরুণ ও ঋতেশ মিনজ দুই ভাই। দু’জনেই জন্মান্ধ। তাদের বাবা ডুয়ার্সের নাগরাকাটার নিউ সাইলি চা বাগানের শ্রমিক। মা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। মাধ্যমিকে অরুণ পেয়েছে ৫৭৯ আর ঋতেশ ৫৭৪। অরুণ পাঁচটি বিষয়ে এবং ঋতেশ ছ’টি বিষয়ে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। অরুণের কথায়, “আমাদের পক্ষে তো সব কাজ করা সম্ভব নয়, আমরা ফিজিওথেরাপিস্ট হতে চাই। ভাইও তা-ই চায়।” লাজুক ভাই অবশ্য এত কথা বলেনি। তার ছোট্ট বক্তব্য, “আরও পড়াশোনা করব।”
জঙ্গল থেকে শালপাতা কুড়িয়ে বিক্রি করে অভিজিৎ মাইতি। বাবা-মায়ের সঙ্গেই জঙ্গলে যায়। শালপাতা বেচে সপ্তাহে আড়াইশো টাকা আয় হয়। এতে চলে না। অভিজিতের বাবা প্রকাশবাবু স্থানীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে বসে নিরক্ষর গ্রাহকদের রসিদ লিখে দিয়ে দিনে গোটা তিরিশেক টাকা রোজগার করেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম বাণী বিদ্যাপীঠের ছাত্র অভিজিৎ এ বার মাধ্যমিকে ৫৩৫ পেয়েছে। তার কথায়, “একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান শাখায় পড়তে চাই। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চাই।” তবে ছেলের স্বপ্নপূরণ নিয়ে সংশয়ে প্রকাশবাবু ও মা উমাদেবী। অভিজিতের স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকাশকুমার মণ্ডল অবশ্য জানান, ওই ছাত্রকে স্কুল থেকে সব রকম সাহায্য করা হবে।
একই স্বপ্ন ঘাটালের সৌরভ জানার। কিন্তু ৬৬৪ নম্বর পেয়েও তার চোখে জল। কারণ, এত ভাল ফল করা সত্ত্বেও অর্থাভাবে ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, জানা নেই। ঘাটাল থানার কুলদহ গ্রামে মাটির বাড়ি সৌরভদের। ছোট থেকেই অনটন নিত্যসঙ্গী। সংসারের প্রয়োজনে বাবার সঙ্গে মাঠের কাজেও হাত লাগায় সৌরভ। তার পরেও বরাবরই ক্লাসে প্রথম হয়েছে সে। এ দিন তার বাবা অজিত জানা বলেন, “চাষ করে দুই ছেলেকে পড়াচ্ছি। সৌরভের জন্য তো আগামী দিনে আরও টাকা খরচ হবে। কী করে করব ভেবে পাচ্ছি না।” |
অরুণ মিনজ |
ঋতেশ মিনজ |
মুন্না প্রামাণিক |
|
হাওড়ার শ্যামপুরের ডিঙেখোলার বাসিন্দা মধুসূদন প্রামাণিক যখন মেয়ের কাছ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফলের খবর পেলেন, তখন সবে আমগাছ থেকে নীচে নেমেছেন তিনি। জেনেছেন, মেয়ে মুন্না মাধ্যমিকে পেয়েছে ৬৩০। মধুসূদনবাবু ইটভাটার শ্রমিক। কিন্তু এখন মরসুম শেষ হওয়ার সেই কাজ বন্ধ। তাই তিনি চলে গিয়েছেন হুগলির চন্দননগরের কাছে একটি গ্রামে। সেখানে আমবাগানে অস্থায়ী চাকরি নিয়েছেন তিনি। কাজ, গাছে উঠে আম পেড়ে গুছিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো। মেয়ে গুজারপুর শিবগঞ্জ বিশালাক্ষী হাইস্কুলের ছাত্রী। ওই স্কুলের ৯৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে সে-ই পেয়েছে সর্বোচ্চ নম্বর। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায় মুন্নাও। মধুসূদনবাবু বলেন, “সামান্য আয়ে সংসার চালানো কঠিন। অনেকে মেয়ের পড়াশোনায় সাহায্য করেছেন। সেই সাহায্য বিফল হয়নি। আমি খুব খুশি।”
সাইবা, অরুণরা জানে, মাধ্যমিকে সাফল্যের আনন্দে গা-ভাসানো ওদের জন্য নয়। সামনে আরও কঠিন লড়াই। পরের ধাপের পরীক্ষাগুলো টপকে যাওয়ার জন্য আরও একবার দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে ওরা। |