সোমবার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রথম দফার বিজ্ঞপ্তি জারি হলেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকারের বিরোধ মেটার কোনও লক্ষণ নেই।
আদালতের নির্দেশ মতো মনোনয়নপত্র জমা শুরু হওয়ার দিন থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার কথা রাজ্য সরকারের। সেই মতো তথ্য জানিয়ে তাদের চিঠিও দেওয়ার কথা কমিশনকে। কিন্তু সোমবার সন্ধে পর্যন্ত সেই চিঠি পায়নি কমিশন। উল্টে প্রার্থীদের সম্পত্তির হিসেব দেওয়া নিয়ে কমিশনের একটি নির্দেশকে কেন্দ্র করে এ দিন বিরোধের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে এত দিন জেলা পরিষদের সদস্যপদে যাঁরা দাঁড়াতেন, তাঁদের সম্পত্তির হিসেব দিতে হতো। এ বারই প্রথম কমিশনের নির্দেশে পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রেও প্রার্থীদের সম্পত্তির হিসেব দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিশনের এই নির্দেশ গত মার্চ মাসে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্য প্রশাসনকে। কিন্তু এই নিয়ে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান, কেন বিষয়টি তাঁকে জানানো হয়নি? পঞ্চায়েতমন্ত্রী তাঁকে জানান, ওই নির্দেশ কমিশন পাঠিয়েছে জেলাশাসকদের কাছে। রাজ্যের মুখ্যসচিব ও পঞ্চায়েত সচিব এমন কোনও নির্দেশ পাননি। তাঁর এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন মুখ্যসচিব। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, কমিশনের এই নির্দেশ সরকার কোনও মতেই মানবে না। তাঁর যুক্তি, পঞ্চায়েত আইনেও এই কথা বলা নেই। ক্ষুব্ধ মমতা বলেন, ভোটে ৩-৪ লক্ষ প্রার্থী হবে। নোটারি কী, অনেক প্রার্থী তা জানেনই না। |
এ দিন বিকেল ৪টে নাগাদ নির্বাচন কমিশন প্রথম দফার পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি পাঠায় মহাকরণে। তার আগে ১৭টি জেলার মুখ্য পর্যবেক্ষকদের নিয়ে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন কমিশনার মীরা পাণ্ডে-সহ অন্য কর্তারা। পরে সন্ধেয় সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মীরাদেবী বলেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে সব ক’টি জেলাতেই নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হয়ে গেল।”
কিন্তু রাজ্য কি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে কিছু জানিয়েছে? জবাবে মীরাদেবী পরিষ্কার জানিয়ে দেন, “নিরাপত্তা বাহিনী প্রসঙ্গে রাজ্য সরকার এ দিন সন্ধে পর্যন্ত আমাদের কিছু জানায়নি।” তাঁর বক্তব্য, আইন-শৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব রাজ্যের। কমিশন আশা করে, হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশমতো রাজ্য সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু রাজ্য কোনও কিছু না জানালে বা পর্যাপ্ত বাহিনী দিতে না পারলে তখন কমিশন কী করবে? মীরাদেবীর বক্তব্য, “এ বিষয়ে এখনই কিছু স্পষ্ট করে বলতে চাই না। পরবর্তী পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত হবে।”
মহাকরণের খবর, রাজ্য সরকার এখনও পর্যন্ত ভিন রাজ্যের বাহিনী পাওয়া নিয়ে কোনও লিখিত প্রতিশ্রুতি পায়নি। তবে মৌখিক ভাবে কয়েকটি রাজ্য বাহিনী দেবে বলে জানিয়েছে। তাতে খুব বেশি হলে ১০-১৫ কোম্পানি বাহিনী পেতে পারে রাজ্য। কিন্তু বুথ কেন্দ্রে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চ যে নির্দেশ দিয়েছে, তাতে কেন্দ্র বা অন্য রাজ্য থেকে বেশ ভাল সংখ্যক সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবস্থা করতেই হবে রাজ্য সরকারকে।
এ দিনই রাজ্য বামফ্রন্টের বৈঠকের পরে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “শুধু ভোটের দিন ঘোষণা করলেই হবে না, যাতে সমস্ত প্রার্থী নির্বিঘ্নে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে কমিশনকে।” কোচবিহারে জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক তথা সাংসদ তারিণী রায়ের উপর তৃণমূলের আক্রমণের প্রসঙ্গ তুলে বিমানবাবু বলেন, “সাংসদ আক্রান্ত হচ্ছে। কমিশনকে সমস্ত প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।” বিমানবাবুর অভিযোগ, “যাতে বাম কর্মীরা মনোনয়নপত্র জমা না দেন, তার জন্য বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তৃণমূল হুমকি দিচ্ছে।”
এই একই বিষয় নিয়ে মীরাদেবীও এ দিন প্রশ্ন করা হয়। তিনি জানান, মনোয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন থেকেই নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করার ব্যাপারে তাঁরা রাজ্যকে আগেই বলেছেন। এ দিন তিন দফার ভোটপর্বের কথা ঘোষণা করে কমিশন। ভোট হবে ২, ৬ এবং ৯ জুলাই। অর্থাৎ প্রথম দফার ভোটের মনোনয়ন দেওয়া শুরু হচ্ছে ২৯ মে থেকে। সুতরাং আজ, মঙ্গলবারের মধ্যে কমিশনকে অন্তত প্রথম পর্বের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি সরকারের জানিয়ে দেওয়া উচিত।
এখনও পর্যন্ত কমিশনের চাহিদামতো সংখ্যার পর্যবেক্ষকের তালিকাও পাঠিয়ে উঠতে পারেনি রাজ্য। এই নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় এ দিন মহাকরণের কাছে পর্যবেক্ষকদের তালিকা চেয়ে পাঠায় রাজভবন। তড়িঘড়ি সেই তালিকা পাঠিয়ে দেয় রাজ্য। আজ, মঙ্গলবার মুখ্যসচিবের সঙ্গে রাজ্যপালের বৈঠকে এই বিষয়টিও উঠতে পারে বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
প্রশাসনের এক কর্তা জানান, কমিশনের কাছে এ পর্যন্ত ৪৫০ জন পর্যবেক্ষকের নাম পাঠিয়েছে রাজ্য। তাতে ৪৬ জন আইএএস, ২৯৮ জন ডব্লিউবিসিএস, রাজ্য সেক্রেটারিয়েট সার্ভিসেসের ৫১ জন, ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস বা আইএফএসের ২৫ জন এবং ৩০ জন কর্মাশিয়াল ট্যাক্স অফিসারের নাম রয়েছে। কিন্তু সর্বভারতীয় চাকরির বিধি অনুযায়ী আইএফএস-দের নির্বাচনের কাজে লাগানো যায় না বলে কমিশন তাঁদের নাম বাতিলের নির্দেশ দেয় সরকারকে। কমার্শিয়াল ট্যাক্স অফিসারদের ব্যপারেও আপত্তি তোলেন ডব্লিউবিসিএস অফিসারেরা। তাঁদের বক্তব্য, ওই অফিসারেরা কখনও নির্বাচনের কাজ করেননি। তাই পর্যবেক্ষক হিসেবে তাঁরা কতটা সফল হবেন, সেই প্রশ্ন থাকছেই। সেই দাবি মেনে ট্যাক্স অফিসারদেরও নাম কেটে দেয় রাজ্য সরকার। এতে পর্যবেক্ষকের সংখ্যায় টান পড়ে। কমিশন বিষয়টি রাজ্যকে জানালে নতুন করে পর্যবেক্ষকের খোঁজ শুরু করেছে মহাকরণ। |