রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের পাওয়া হুমকি চিঠি নিয়ে ২৪ ঘণ্টা পরেও তদন্ত শুরু করেনি রাজ্য সরকার। মহাকরণ সূত্রে জানানো হয়েছে, চিঠিগুলির বিষয়বস্তু যাচাই করে দেখা হচ্ছে যে, সেগুলি আদৌ তদন্তসাপেক্ষ কি না। শুধু তাই নয়, হুমকি-চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক ভাবে মীরাদেবীর নিরাপত্তা বাড়ানো নিয়ে চিন্তাভাবনা হলেও শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সে সব কিছুই হয়নি বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি এই চিঠিগুলি পান মীরাদেবী। সেখানে তাঁকে তো বটেই, তাঁর একমাত্র ছেলেকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি শুক্রবার বিষয়টি রাজ্য সরকারকে জানান। প্রাথমিক ভাবে সরকারের পক্ষ থেকে মীরাদেবীর নিরাপত্তা বাড়ানো এবং বিষয়টি নিয়ে তদন্তের কথা বলা হলেও শনিবার পর্যন্ত তা হয়নি। এই প্রসঙ্গে সরকারের এক শীর্ষকর্তার যুক্তি, “নির্বাচন কমিশনার নিজেই লিখেছেন, চিঠিতে তাঁর বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ অসত্য। তাই যদি হবে, তা হলে আর তদন্তের কী প্রয়োজন?” তাঁর কথায়, “চিঠিতে কাউকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়নি। তবে তদন্তের ব্যাপারে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।”
কমিশনের এক কর্তা পাল্টা
প্রশ্ন তুলেছেন, যে তিনটি চিঠি এবং একটি লিফলেট কমিশনের অফিসে এসেছে, তা কি ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া চিঠি নয়? তিনি জানিয়েছেন, তবে এই হুমকি-চিঠিতে মীরাদেবী ভীত নন। কিন্তু এটা তো সামগ্রিক ভাবে কমিশনের উপরে আঘাত। তাই কে এমন চিঠি পাঠাচ্ছে, কেন পাঠাচ্ছে, তার তো তদন্ত হওয়া উচিত। সেই তদন্তই চাওয়া হয়েছে বলে তাঁর দাবি। তিনি আরও বলেন, কমিশন নিজে কোনও এফআইআর না করে সরকারকে জানানোটাই শ্রেয় মনে করেছে। এখন তা তলিয়ে দেখা রাজ্য সরকারের কাজ। মীরা পাণ্ডে নিজে অবশ্য এ দিন বলেছেন, “আমি এই প্রসঙ্গে একটি কথাও বলব না।”
সরকারি সূত্রের খবর, এই তিনটি চিঠি এবং একটি লিফলেটে মীরাদেবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তিনি সিপিএম-কংগ্রেসের হয়ে কাজ করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরনের আর্থিক অভিযোগও তোলা হয়েছে। একটি চিঠিতে কমিশনের সচিব এবং মীরাদেবীর পুত্রকে নিয়েও অভিযোগ করা হয়েছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। ওই সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, প্রতিটি চিঠিতেই বলা হয়েছে, নিজেকে শুধরে না নিলে ফল ভুগতে হবে। যদিও সরকার এই চিঠিগুলিকে হুমকি চিঠি বলতে নারাজ। |
সরকারি সূত্রের খবর, মীরাদেবীকে পাঠানো একটি চিঠি ২৬ মার্চ লেখা, একটি আইনি সহায়তা সংস্থার যেটি পাঠিয়েছেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জয়দীপ। সরকারি সূত্রে জানানো হচ্ছে, চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনার পক্ষপাতদুষ্ট, সিপিএমের হয়ে কাজ করছেন। তিনি যেন নিজেকে শুধরে নেন। তা না হলে তাঁকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। জয়দীপবাবু এ দিন চিঠি পাঠানোর কথা মেনে নিয়ে বলেছেন, “হ্যাঁ, আমি চিঠি দিয়েছি। তবে হুমকি দিইনি। পরামর্শ দিয়েছি। সংসদীয় গণতন্ত্রে তা দেওয়ার অধিকার আমার আছে।” মীরাদেবীর সঙ্গে সিপিএমের যোগ নিয়ে অভিযোগের প্রমাণ কী? জয়দীপবাবু বলেন, “কমিশনার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়ে এখনও কাজ করছেন না। এখন এটুকুই বলছি।”
সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, তিনটি চিঠির একটি এসেছে দিল্লি থেকে। সেটি কলকাতা হাইকোর্টের রঞ্জন চতুর্বেদী নামে এক আইনজীবী পাঠিয়েছেন বলে খবর। তবে হাইকোর্টে ওই নামের কোনও আইনজীবীর খোঁজ এ দিনও পায়নি প্রশাসন। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই চিঠিতে লেখা হয়েছে, সিপিএম-কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন মীরাদেবী ও তাঁর পরিবার। তাঁর ছেলে সিপিএম নেতাদের সঙ্গে ব্যবসা করেন। সম্প্রতি একটি কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকার বরাতও পেয়েছেন তিনি। ওই চিঠিতে মীরাদেবী ‘নিজেকে বদলে ফেলে নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করুন’ বলেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, জানিয়েছে প্রশাসনের সূত্রটি। হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, নইলে ফল ভাল হবে না। এই চিঠিটিও মার্চ মাসের শেষে কমিশন দফতরে এসেছিল। দু’টি চিঠি পেলেও তখন পর্যন্ত সেগুলিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে। সরকার খোঁজ নিয়ে জেনেছে, মীরাদেবীর পুত্র একটি নামজাদা তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। তিনি কখনও ব্যবসা করেনি। তিনি কলকাতাতেই থাকেন না।
প্রশাসন সূত্রের খবর, গত এপ্রিল মাসের শেষে কমিশনে একটি লিফলেট আসে। তাতে বলা হয়, বেশ কয়েক জন বিচারপতি, বিভিন্ন টিভিতে আলোচনায় যোগ দেওয়া দুই কংগ্রেস নেতা, কয়েক জন সিপিএম নেতা এবং কমিশনার ও তাঁর পরিবার মুম্বইয়ের একটি অর্থলগ্নি সংস্থার থেকে নানা সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। লিফলেটটির ভাষা আপত্তিকর বলেই প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে।
মীরাদেবীর উদ্দেশে শেষতম চিঠিটি আসে গত ১৯ মে। প্রশাসন সূত্রের খবর, এই চিঠিটিই সবচেয়ে আক্রমণাত্মক। তাই চিঠি পেয়েই রাজ্যকে বিষয়টি জানানোর সিদ্ধান্ত নেন নির্বাচন কমিশনার। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, বেহালা পর্ণশ্রীর রুবিদাস পার্ক এলাকার বাসিন্দা রেবা মাইতির আইনজীবী হিসাবে শঙ্খশুভ্র দাস নামে এক ব্যক্তি আইনি নোটিস পাঠান রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে। সাত দিনের মধ্যে তার জবাব দিতেও বলা হয় চিঠিতে। সেই চিঠিতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের নানা অভিযোগ তোলার পাশাপাশি লেখা হয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এক সিপিএম নেতার মাধ্যমে মীরাদেবী এবং কমিশনের সচিব আর্থিক
সুবিধা পেয়েছেন।
শেষ চিঠির ঠিকানা ধরে বেহালায় ওই বাসিন্দার খোঁজ করে প্রশাসন। কিন্তু ওই ঠিকানা এবং ব্যক্তি, কারওরই খোঁজ মেলেনি। চিঠিতে হাইকোর্টের ৮ নম্বর ঘরে শঙ্খশুভ্রবাবু বসেন বলা হলেও সেই ঘরে এই নামে কোনও আইনজীবীর খোঁজ পায়নি প্রশাসন। হাইকোর্টে বার অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনিও ওই নামের কোনও আইনজীবীর সন্ধান দিতে পারেননি। |