মাটির গানের শিল্পী মিহিরলাল সিংহ দেওকে অবশেষে লালন পুরস্কার দেওয়ায় খুশি রাঢ় বাংলার মানুষ। রবিবার ভোরে পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে চুয়াত্তর বছরের ওই ঝুমুর শিল্পীর প্রতিক্রিয়া, “ঝুমুরের রস সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার সাধনা করে গিয়েছে। মানুষ ঝুমুরকে মনে রাখলে, আগামী দিনে চর্চা করলেই আমার কাজ সার্থক হবে।” এ দিন পুরুলিয়ায় তাঁকে সংবর্ধনা জানান রাজ্য আদিবাসী ও লোক সংস্কৃতি পরিষদের সদস্য নিয়তি মাহাতো। তাঁরাই শিল্পীকে পুঞ্চার রাজনওয়াগড়ের বাড়িতে পৌঁছে দেন। |
পুরুলিয়া স্টেশনে মিহিরলাল সিংহ দেও।—নিজস্ব চিত্র। |
ঝুমুরকে কবে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, মিহিরবাবু নিজেও তা স্মরণ করতে পারেন না। পঞ্চকোট ঘরানার এই অন্যতম শেষ সাঙ্গীতিক উত্তরাধিকারীর বিশেষত্ব হল তিনি লাল মাটির দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রচলিত ঝুমুরে নয়, নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন দরবারি ঝুমুরের সাধনায়। তাঁর কথায়, “পঞ্চকোট রাজবংশের একটা সাঙ্গীতিক ঘরানা রয়েছে। সেই বংশের সন্তান হিসেবে আমি কাছ থেকে নীলকমল কথক, কালু কথক প্রমুখ শিল্পীদের দেখেছি। আগে টাঁড় ও ডাঁড় ঝুমুরই জেলা জুড়ে রসিকদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তী কালে রাধাকৃষ্ণের প্রেম ও বিরহ বিষয়ক ঝুমুরে শ্রোতারা রস পান। ঝুমুরের একটা অন্য আবেদন রয়েছে, সুরেও একটা মাদকতা রয়েছে। খেউড়-খেমটা ঝুমুর গান যাঁদের পছন্দের তালিকায় নেই, অথচ ঝুমুর যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা এই ঝুমুরের রসের আস্বাদন পেয়ে গেলেন।” ট্রেন যাত্রার ক্লান্তি ছাপিয়ে তাঁর সুরেলা গলায় উঠে আসে দুর্গা, ভৈরবী বা জয়-জয়ন্তীর মিলিত সুরে বাঁধা কোনও কলি। বলেন, “দরবারি ঝুমুরে নানা রাগ-রাগিনীর মিশ্রণ রয়েছে। কিন্তু কোনও রাগই প্রকট নয়, তাহলে তা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হয়ে যাবে। এখানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঠাটটা বজায় রাখতে হয়।”
ঝুমুরকে জনপ্রিয় করার সঙ্গে সঙ্গেই মিহিরবাবুও নানা জায়গা থেকে সম্মান পেয়েছেন। আশির দশকে চণ্ডীগড়ের প্রাচীন কলাকেন্দ্র থেকে পান ‘সঙ্গীত বিশারদ’ সম্মান। ১৯৮৭ সালে এলাহাবাদের প্রয়াগ সঙ্গীত সমিতি তাঁকে ‘সঙ্গীত প্রভাকর’ সম্মান দেয়। পরবর্তীকালে বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ থেকে ‘সঙ্গীত বিভাবর’ সম্মান পান। এ বার রাজ্য সরকারের লোক সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘লালন পুরস্কার’ পেলেন। আগামী প্রজন্মের জন্য এই প্রবীণ শিল্পী রচনা করেছেন ঝুমুর ও স্বরলিপি। ঝুমুরের উপর বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন তিনি। পুরুলিয়ার অন্যতম লোক গবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, “মিহিরদা দীর্ঘদিন একটা পৃথক ঘরানার ঝুমুর অর্থাত্ দরবারি ঝুমুরের চর্চা করছেন। এই বয়সেও তিনি অনুষ্ঠান করছেন।” পুরুলিয়ার জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক সিদ্ধার্থ বসু বলেন, “এই সম্মান প্রাপ্তি অবশ্যই পুরুলিয়ার গর্ব।” মিহিরবাবুর সঙ্গী বঙ্কিম চক্রবর্তী বলেন, “রাজ্য সরকার এই শিল্পীর জন্য মাসিক ৭৫০ টাকা পেনশনের কথা ঘোষণা করেছেন। মিহিরবাবুর ইতিমধ্যেই বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছেন। পেনশনের পরিমাণ আরও বাড়ানো হলে ভাল হত।” |