বরফে পা ফেলে ফেলে ছুঁতেই হবে পাহাড়চুড়ো
ক্ষ্য, উচ্চতাকে জয় করা।
প্রতিপক্ষের ভূমিকায় ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রকৃতি।
অলিম্পিক বা কোনও বিশ্বকাপ কোথাও স্বীকৃতি নেই। তবু কলকাতা-সহ বাংলার প্রতিটি জেলা থেকে রুকস্যাক পিঠে একা কিংবা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েন অনেকেই।
জীবন বাজি রাখলেও সরকারি নথিতে ওঁরা ‘খেলোয়াড়’ নন। তবু ব্যাঙ্কঋণ কিংবা মহাজনের থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করেই পাহাড়চুড়োয় ওঠেন ওঁরা।
কয়েক দিন আগেই এভারেস্ট অভিযানে ফুরিয়ে গিয়েছে দু’টি তাজা জীবন বাংলাদেশের চিত্রপরিচালক সজল খালেদ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় সাং হো সিউ। নেপালে ধৌলাগিরি শৃঙ্গ জয় করতে গিয়ে তুষারঝড়ে চরম বিপদে পড়েছেন এভারেস্টজয়ী বসন্ত সিংহরায় ও দেবাশিস বিশ্বাস। মৃত্যুর সাক্ষাৎ করে ফিরেছেন তাঁরা।
কিন্তু তাতে কে দমছে?
ইতিপূর্বে, ২০০১ সালে নন্দাকোট (সাউথ ফেজ) অভিযানে গিয়ে ডান পায়ের আড়াইটে আঙুল খুইয়েছেন ব্যারাকপুরের কল্যাণ দেব। তাঁর কথায়, “যে বছর দুর্ঘটনা ঘটে, তার পরের বছরই চিকিৎসককে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম পাহাড়ে। বাড়িতে বসে থাকতে পারি না।” মনে পড়ে যায়, “নন্দাকোট অভিযানে গিয়ে প্রায় সাড়ে ৫৮ ঘণ্টা খোলা আকাশের নীচে থাকতে হয়েছিল। খাবার থাকলেও খেতে পারিনি প্রায় ৪২ ঘণ্টা। ক্যাম্পে ফেরার পর পায়ে সাড় ছিল না। ফ্রস্ট বাইট হয়েছিল।”

শৃঙ্গের লক্ষ্যে অভিযাত্রীরা।
কলকাতার পর্বত অভিযাত্রী সঙ্ঘের কর্তা শ্যামল সরকার বলেন, “যখন পাহাড়ে গিয়ে বিপদের মুখে পড়ি, তখন মনে হয় পরের বার আর আসব না। কিন্তু সমতলে নেমেই মনে হয়, কবে আবার যাব। বিপদকে জয় করতে পারার একটা আলাদা মজা আছে। সেটা শৃঙ্গ জয় করলে বেশি করে বোঝা যায়।” ২০১১ সালে এভারেস্টে চড়া রাজীব ভট্টাচার্যের মতে, “প্রকৃত অভিযাত্রী কখনই কোনও বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনাকে উদাহরণ করে তাঁর অভিযান জীবনকে থামিয়ে দেন না।”
আসলে বিপদকে জয় করতে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছাই পাহাড়িয়াদের জীবনীশক্তি। সাত হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার একাধিক শৃঙ্গ আরোহণ করা দেবরাজ দত্তের কথায়, “অ্যাডভেঞ্চার প্রতিটা মানুষের রক্তেই থাকে। প্রকৃতির মাপকাঠিতে নিজেকে যাচাই করে নিতেই মানুষের পাহাড়ে যাওয়া।” সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলি নিয়ে তাঁর সোজসাপটা জবাব, “এক দিনে পথ দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যান, দশ বছরে পাহাড়ে গিয়ে মৃত অভিযাত্রীর সংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম।”
কী আছে দুর্গম পাহাড়ে?
অভিযাত্রীদের মতে, আছে ওঠার চ্যালেঞ্জ। লৌহকঠিন স্নায়ুর পরীক্ষা। আর অজানার ডাক। জলপাইগুড়ির নেচার অ্যান্ড ট্রেকার্স ক্লাবের সম্পাদক ভাস্কর দাসের কথায়, “জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করতে হলে পাহাড়ে যেতেই হবে। গাড়ি বা প্লেন থেকে কি আর প্রকৃতি দেখা যায়? প্রকৃতিকে জানতে হলে পাহাড়ের নির্জন কোলেই যেতে হবে। চূড়ায় বসে মনে হয়, নীচে সব শূন্য।” কোচবিহারের নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার স্টাডি গ্রুপের অরূপ গুহর কথায়, “নিজেকে জানার জন্যই পাহাড়ে যাই। এটা একটা নেশা, অন্য অনুভূতিও বটে।”
এখন আর এভারেস্টে উঠতে তেনজিং হতে হয় না, এডমন্ড হিলারিও নয়। এজেন্সির মাধ্যমেই শৃঙ্গ জয় করে ফেলেন অনেকে, আগের মতো আর পরিশ্রম করতে হয় না বলে নিন্দুকে। কিন্তু এই মতের সঙ্গে একমত নন পর্বতারোহণের সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ মানুষই। বসন্ত সিংহরায় বা দেবাশিস বিশ্বাস যাঁদের ঘরের ছেলে, সেই কৃষ্ণনগর মাউন্টেনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ম্যাক) সম্পাদক অশোক রায়ের গলা গম্ভীর শোনায়, “অনেকেই বলছেন, এখন পর্বত জয় নাকি সহজ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সব কিছুই ঠিক থাকলে অভিযাত্রীদের মৃত্যু হচ্ছে কী করে?”
সদ্য এভারেস্টজয়ী হাওড়ার ছন্দা গায়েনের অন্যতম তাইকেন্ডো কোচ ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত বরং আক্ষেপ করেন, “ফুটবল-ক্রিকেটের বাইরে কোনও খেলাই এ দেশে গুরুত্ব পায় না। মেলে না সরকারি আনুকূল্য। এত কিছুর পরেও জীবন বাজি রেখে পাহাড়ে যান কিছু সাহসী মানুষ। এটাই তো অনেক!”
তবে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিলে দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যায় বলে মনে করেন প্রবীণ পর্বতারোহী গৌতম দত্ত। ১৯৯১ সালে বাংলা থেকে প্রথম অসামরিক এভারেস্ট অভিযানের সদস্য গৌতমবাবুর মতে, “নবীন প্রজন্মের অনেক অভিযাত্রীর মধ্যে অভিযানের নেশা থেকে খ্যাতির লোভ বড় হয়ে উঠেছে। দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা যতটা শোক করি, তার কারণ নিয়ে ততটা পর্যালোচনা করি না। তা করলে কিন্তু ভবিষ্যতের অনেক দুর্ঘটনাই এড়ানো যাবে।”
তবে বিপদের পথে অভিযানের নেশা যাদের দিনে-রাতে ডাক দেয়, দুর্ঘটনার ভয় কি তাদের বাঁধতে পারে? বরফে বরফে পায়ের ছাপ রেখে তারা তো হেঁটে যাবেই...
বেসক্যাম্প থেকে সামিট।

পুরনো খবর




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.