সামনে ডিমের পসরা, চোখে এভারেস্ট ছোঁয়ার স্বপ্ন। রবিবার সকালে সেই স্বপ্ন সত্যি হল দমদম পার্কের টুসি দাসের। প্রস্তুতির দীর্ঘ বন্ধুর পথ পেরিয়ে অসামরিক বাঙালি মহিলা হিসেবে এভারেস্টে পা রাখলেন ২৯ বছরের টুসি। ২৭ মার্চ কলকাতা ছাড়ার সময় তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কারণ, অভিযানের জন্য পর্যাপ্ত টাকা জোগাড় করতে টুসিকে যে পথটা পেরোতে হয়েছিল, তার প্রতিটি পদক্ষেপই এক একটা এভারেস্ট।
বাবা জগবন্ধু দাস যখন মারা যান, টুসি তখন ক্লাস সিক্সে। তখন থেকেই মায়ের সঙ্গে বাবার দোকানে ডিম বিক্রির হিসেব শেখে ছোট্ট টুসি। সবিতা দেবী কাপড় কারখানায় কাজ করতে শুরু করলে টুসিই আস্তে আস্তে দোকান চালানোর দায়িত্ব নেয়।
রবিবার সকালে দমদম পার্ক বাজারের সেই ছোট্ট ডিমের দোকানটার সামনে ক্রেতাদের ভিড়। বেশ কয়েক দিন ধরেই দোকানে বসছেন টুসির মা সবিতা দাস। টুসি কেন আসছে না তা অনেকেই জানতেন না। সকাল সাড়ে নটার মধ্যে সবাই জেনে গেলেন, মিনিট দশেক আগেই একটি অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন তাঁদের রোজকার দেখা ছটফটে মেয়েটা। প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছেন আকাশ। উঠে গিয়েছেন পৃথিবীর সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গে।
সবিতা দেবী বললেন, “বেস ক্যাম্প থেকে ফোনে এক শেরপা জানাল, টুসি ন’টা কুড়ি মিনিটে এভারেস্ট পৌঁছেছে। এভারেস্টে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই টুসি স্যাটেলাইট ফোনে খবর দিয়েছিল বেস ক্যাম্পে।”
দমদম পার্কের হরিহর নগরের একটি বস্তিতে টুসিদের বাড়ি। দু’কামরার ছোট দু’টি ঘরে থাকেন টুসি, তাঁর মা ও এক ভাই। দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভাই কাজকর্ম তেমন কিছু করেন না। বাবার দোকানই তাঁদের একমাত্র উপার্জনের উৎস।
টুসিদের দোকানের উল্টো দিকেই ফলের দোকান বাবলু মিস্ত্রির। বাবলু বললেন, “বাবা মারা যাওয়ার পরে কী পরিশ্রমই না করতে দেখেছি ছোট্ট মেয়েটাকে! বলত, ‘এক দিন এভারেস্টে উঠবই।’ সত্যিই ওর স্বপ্ন সফল হল।”
অন্য দিকে ছোট বেলা থেকেই পাহাড়ের সঙ্গেই ভালবাসার সম্পর্ক ছন্দা গায়েনের। যখন বিয়ে করলেন, তখনও শর্ত ছিল স্বামী পর্বত অভিযানে বাধা দেবেন না। কিন্তু সেই বিয়ে স্থায়ী হয়নি। এভারেস্ট জয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়েই তাঁর হাতে এসে পৌঁছেছিল ডিভোর্সের নথি। দুই ভালবাসার মধ্যে পাহাড়কে বেছে নিতে দু’বার ভাবেননি ছন্দা। সেই ভালবাসাই তাঁকে পৌঁছে দিল ৮,৮৪৮ মিটার উচ্চতার শৃঙ্গটিতে।
কিন্তু এভারেস্ট ছোঁয়ার গল্পটা যতটা ঝাঁ চকচকে, অভিযানের পিছনে ছন্দা আর টুসির যে সংগ্রামের কাহিনি রয়েছে, তা কিন্তু ততটা সুখের নয়। |
থানায় উজ্জ্বল রায়ের স্ত্রী ও মেয়ে। (ডান দিকে) ডিমের দোকানে টুসির মা সবিতা দেবী। —নিজস্ব চিত্র |
অভিযানের জন্য ১৭-১৮ লক্ষ টাকা জোগাড় করার সংগ্রাম। স্বামীর ঘর ছাড়ার সময় সব বিয়ের গয়না নিয়ে এসেছিলেন ছন্দা। মায়ের কিছু গয়নাও ছিল। সব বন্ধক দিয়ে তিন লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। রাজ্য সরকারের যুব কল্যাণ দফতর দিয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। বাকি টাকাটা ছন্দা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের থেকে ধার করেছেন। তবে বিনা সুদে।
টুসির দিদি সুপর্ণা বললেন, “টাকা জোগাড়ের লড়াইটা এভারেস্টে ওঠার থেকেও বেশি কঠিন ছিল। মোটামুটি ১৮ লক্ষ টাকা জোগাড় করতে হত।” সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা, পাড়ার ক্লাব, স্থানীয় বিধায়ক সুজিত বসু থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুবকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও।
রবিবার টুসি এবং শনিবার ছন্দার সাফল্যে তাই উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেননি অরূপবাবু। তিনি বলেন, “আমরা যতটা পেরেছি সাহায্য করেছি। তবে আসল কৃতিত্ব টুসি আর ছন্দার। মণিদীপাও চেষ্টা করেছিলেন। এ বার পারেননি, ভবিষ্যতে নিশ্চয় পারবেন।” বিধায়ক সুজিত বসু বলেন, “মেয়েটা যখন আমার কাছে এসে বলে যে ও এভারেস্টে উঠতে চায়, প্রথমে বিশ্বাসই করিনি।”
বাঙালি মহিলাদের এভারেস্ট বিজয়ের হ্যাটট্রিক হয়ে যেত রবিবারই, যদি না শেষ মুহূর্তে ফিরে আসতে হত আর এক অভিযাত্রী মণিদীপা দত্তকে। কলকাতার এক পর্বতারোহী ক্লাবের সদস্যা মণিদীপা তাঁর জামাইবাবু শ্যামপুকুর থানার ওসি উজ্জ্বল রায় এবং ক্লাবের অন্য এক সদস্য দেবদাস নন্দীর সঙ্গে এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ শৃঙ্গের ১৫০ মিটার নীচে শ্বাসকষ্ট হওয়ায় নেমে আসেন মণিদীপা। কিন্তু রবিবার সকাল ৬ টা ৩৫ মিনিটে এভারেস্টে পা রাখেন উজ্জ্বলবাবু ও দেবদাসবাবু।
অভিযানে রওনা দেওয়ার আগে পুলিশ কমিশনার সুরজিত কর পুরকায়স্থ তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জাতীয় পতাকা এবং কলকাতা পুলিশের পতাকা। রবিবার সকালে দু’টি পতাকাই এভারেস্টের চূড়ায় পুঁতে এসেছেন শ্যামপুকুর থানার ওসি উজ্জ্বল রায়। রবিবার দুপুর থেকেই শ্যামপুকুর থানায় উৎসবের আবহ। উচ্ছ্বসিত ডিসি (নর্থ) গৌরব শর্মা বলেন, “আমরা কলকাতা পুলিশের প্রত্যেকেই এই সাফল্যে গর্বিত।”
স্বামী তো বটেই, একসঙ্গে এত জন বাঙালির এভারেস্ট বিজয়ে দারুণ খুশি উজ্জ্বলবাবুর স্ত্রী জাহ্নবীদেবী। শ্যামপুকুর থানায় তিনি বলেন, পর পর বাঙালির এই এভারেস্ট জয়ে খুব ভাল লাগছে। আর এর মধ্যে এক জন যখন নিজের লোক তখন বাড়তি আনন্দ তো হবেই।” |