মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশই সার!
১৫০ টাকায় দর বেঁধে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু শুক্রবারেও কলকাতার বিভিন্ন খোলা বাজারে ছাড়ানো মুরগির মাংস বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা কিলোগ্রাম দরে।
বাজারে মুরগির মাংসের দাম ভীষণ বেড়ে গিয়েছে। এতটাই যে, যে-কোনও দিন তা ২০০ টাকায় পৌঁছবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় মঙ্গলবার মহাকরণে সরকারি কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই না-থেমে ওই দিন তিনি নির্দেশ দেন, বাজারে ন্যায্য দামে মুরগির মাংস বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি দাম বেঁধে দেন ১৫০ টাকা কেজি। সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে তিনি জানান, রাজ্য নিজেই কয়েকটি জায়গা থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে মুরগির মাংস বিক্রি করবে।
মুখ্যমন্ত্রীর কথা রাখতে ৪৮ ঘণ্টাও সময় নেয়নি প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর। প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বৃহস্পতিবার কলকাতায় ১০টি সরকারি স্টলে নির্ধারিত দামে মুরগি বিক্রি শুরু হয়। খাস মহাকরণেও খোলা হয় ন্যায্য দামের মুরগির স্টল। কিন্তু ওই পর্যন্তই! সরকারি স্টলে যা-ই হোক, খোলা বাজার মমতার নির্দেশ মানার তাগিদ তেমন দেখায়নি। তাঁর নির্দেশকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বৃহস্পতি-শুক্রবারেও বাজারে মুরগি বিকিয়েছে ১৮০ টাকা কেজি দরেই।
প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর অবশ্য বলছে, সরকারি-মুরগির মাংসের দাম কেজি প্রতি ১৫০ টাকা করায় খোলা বাজারেও ১০ থেকে ১৫ টাকা দাম কমেছে। তবে কোন বাজারে তা পাওয়া যাচ্ছে, সেই তথ্য দিতে পারেননি দফতরের কর্তারা। দফতরের অধীন লাইভস্টক উন্নয়ন পর্ষদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জয়ন্ত চৌধুরীর দাবি, “খোলা বাজারে দাম কমেছে।” উদাহরণ হিসেবে তিনি মানিকতলা বাজারের নামও করেন। কিন্তু দফতরের মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী মুরগি নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি।
খোলা বাজারে দাম না-কমুক, মমতার উদ্যোগের সাফল্য হিসেবে সরকারি স্টলের দৃষ্টান্ত দেওয়া হচ্ছে। গত দু’দিনে ১০টি সরকারি স্টল থেকে ন্যায্য দামে ৪৫০ কেজি মাংস বিক্রি হয়েছে বলে সরকারের দাবি। আজ, শনিবার ছুটির দিনে ওই সব স্টলে ২৫০ কেজি মুরগি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্তাদের আশা, ছুটির দিন থাকায় সব মাংস বিক্রি হয়ে যাবে। এ দিন আশুবাবুর বাজারের ভ্রাম্যমাণ ভ্যান থেকে ২৫ কেজি সরকারি মুরগি বিক্রি হয়েছে বলে জানান দফতরের এক কর্তা।
কিন্তু মহানগরে ১০টি সরকারি স্টলে নির্দিষ্ট দামে মুরগি বিক্রির খতিয়ান সারা রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ রূপায়ণের প্রমাণ হতে পারে না বলে ভোক্তাদের অভিমত। মমতার নির্দেশ সত্ত্বেও রাজ্য জুড়ে ১৫০ টাকা কেজি দরে মুরগি বেচা যাচ্ছে না কেন?
ফোরাম অফ ট্রেডার্স অর্গানাইজেশনের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ কোলে বলেন, “বিভিন্ন বাজারের মুরগি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। দাম এত বেড়েছে যে, কোনও মতেই ১৫০ টাকা কেজি দরে ছাড়ানো মুরগি বেচা যাবে না। ‘না-লাভ, না-লোকসান’-এর ভিত্তিতে বিক্রি করলেও ১৬০ টাকার কমে তা সম্ভব নয়।”
কিন্তু দাম বাড়ল কেন?
সরকার মুরগির দাম বাড়ার কারণ জানে না বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের কর্তারা। আর রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় ওড়িশা, বিহার ঝাড়খণ্ড, অসম ও সিকিমে মুরগি বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে এখানকার বাজারগুলিতে সরবরাহে ঘাটতি হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমরা আবেদন জানাব, এটা আটকানোর জন্য কিছু একটা করুন।”
সরকার ১৫০ টাকায় মুরগি খাওয়াচ্ছে কী ভাবে?
সরাসরি জবাব এড়িয়ে মুরগি ব্যবসায়ী মহলের বক্তব্য, অন্তত ১৬০ টাকা দাম না-নিলে শুধু বেসরকারি ক্ষেত্রে নয়, সরকারি উদ্যোগেও বেশি দিন মুরগি বেচা কঠিন হবে। কেন?
ব্যবসায়ীদের ব্যাখ্যা, খামার থেকে পাইকারি বাজারের জন্য মুরগি কিনতে গেলে দাম পড়ে পড়ে ৯২ টাকা কেজি। খুচরো বাজারের মুরগি বিক্রেতা সেটা কেনেন ১১০ টাকা কেজি (পালক-সহ) দরে। এক কেজি মুরগি কাটার পরে মাংস মেলে ৬০০ থেকে সাড়ে ৬৫০ গ্রাম। খুচরো বিক্রেতাকে দোকানের ভাড়া, মুরগি রাখার খাঁচা, আলো এবং প্লাস্টিকের ব্যাগের খরচ বহন করতে হয়। তার সঙ্গে আছে তাঁর শ্রম। সব মিলিয়ে যা খরচ পড়ে,
তাতে পালক বাদ দিয়ে এক কেজি মুরগির মাংস বেচে সাত থেকে ন’টাকার বেশি লাভ থাকে না। তাই ১৫০ টাকায় মুরগি বিক্রি করলে লোকসানই হবে বলে পোলট্রি ব্যবসায়ীদের দাবি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের প্রেক্ষিতে ১০ দিন পরে প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের একটি বৈঠক করার কথা। সেখানে মুরগির সরকারি দাম ১৬০ টাকা করার দাবি জানাবেন ব্যবসায়ী-প্রতিনিধিরা।
তাইল্যান্ডের সংস্থা সিপি ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ও মনে করেন, “সরকারি উদ্যোগটা ভাল। তবে কেজি-প্রতি মুরগির দাম ১৬০ টাকা করা হলে খোলা বাজারেও তার ভাল প্রভাব পড়বে। মুরগির চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য থাকলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।”
|