রাজ্য সরকারের তরফে বিরোধিতা না-থাকায় গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে পুলিশ-হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত তৃণমূল কাউন্সিলর মহম্মদ ইকবাল (ওরফে মুন্না) সহজে জামিন পেয়ে গিয়েছেন বৃহস্পতিবার। মায়ের অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে। একই ঘটনায় হাঙ্গামা-সংঘর্ষের অন্য মামলায় অভিযুক্ত কংগ্রেস
নেতা মোক্তার আহমেদ অবশ্য শুক্রবার জামিন পেলেন না। মুন্নার ক্ষেত্রে বাদ না-সাধলেও এ দিন আদালতে মোক্তারের জামিন-আর্জির তীব্র বিরোধিতা করেছে সরকারপক্ষ, যা আরও উস্কে দিয়েছে জামিন-বিতর্ককে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাহার ঘিরে গণ্ডগোল বাধে। অবাধে বোমা-গুলি ছোড়া হয়। পুলিশের অভিযোগ: সংঘর্ষে এক পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বরোর তদানীন্তন চেয়ারম্যান মুন্না, অপরপক্ষে কংগ্রেসের মোক্তার। এবং সে দিন ইকবালের সঙ্গীদের ছোড়া গুলিতে সাব ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরীর মৃত্যু হয় বলে পুলিশের অভিযোগ। |
ঘটনার দু’দিন বাদে মুন্না গা ঢাকা দিয়েছিলেন। ৭ মার্চ বিহারের ডেহরি-অন শোনে তিনি গ্রেফতার হন। গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে হাঙ্গামা-সংঘর্ষের মামলা ছাড়াও ইকবালদের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে পুলিশ-খুনের একটা আলাদা মামলা, যার চার্জশিট হয়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার আলিপুরের জেলা ও দায়রা জজের আদালতে সেই মামলায় মুন্নার জামিন হয়েছে। আর যেটায় চার্জশিট এখনও পেশ হয়নি, সেই হাঙ্গামা-সংঘর্ষের মামলাটিতে মুন্না, মোক্তার দু’জনেই অভিযুক্ত। তাতে মুন্না আগেই জামিন পেয়ে গিয়েছিলেন। তবে এ দিন একই মামলায় মোক্তারের জামিন হল না।
গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের তদন্তভার নিয়ে সিআইডি গত ২৬ ফেব্রুয়ারি হাওড়া স্টেশনে মোক্তারকে গ্রেফতার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য খুনের মামলা নেই।
এ দিন মোক্তারের জামিনের আবেদনের সওয়ালে তাঁর কৌঁসুলি চন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, হাঙ্গামা-সংঘর্ষের মামলাটিতে মুন্না ছাড়াও আর এক অভিযুক্ত ইমতিয়াজের জামিন হয়েছে। মোক্তার ৮৮ দিন জেল হেফাজতে রয়েছেন, তাঁর কাছে পুলিশ কোনও অস্ত্রও পায়নি। ইকবাল ও মোক্তারের টিআই প্যারেড হয়ে গিয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন কোনও তথ্য-প্রমাণ পুলিশ আদালতে পেশ করতে পারেনি। “মুন্না ও মোক্তার দুই অভিযুক্তের আইনগত অবস্থান এক। কাজেই মোক্তারকে জামিন দেওয়া হোক।” আদালতকে আর্জি জানান চন্দ্রজিৎবাবু। অন্য দিকে আর্জির তীব্র বিরোধিতা করে সরকারি কৌঁসুলি তীর্থঙ্কর রায় সওয়ালে বলেন, মোক্তার জামিনে ছাড়া পেলে সাক্ষীদের ভয় দেখাতে পারেন, এমনকী তথ্য-প্রমাণও লোপাট করতে পারেন। উপরন্তু মুন্না-মোক্তারেরর আইনি অবস্থান এক নয় বলে দাবি করেন তিনি। সওয়াল-জবাব শেষে আলিপুরের দায়রা ও জেলা জজ (ভারপ্রাপ্ত) সুদেব মিত্র মোক্তারের জামিনের আবেদন খারিজ করে দেন।
বৃহস্পতিবার মুন্নার জামিনের বিরোধিতা না-করায় আইনজীবী ও বিরোধী রাজনৈতিক মহলের একাংশ প্রশ্ন তুলেছিল। আর এ দিন সরকারপক্ষ যে যুক্তি দেখিয়ে মোক্তারের জামিনের বিরোধিতা করেছে, তা নিয়েও নতুন বিতর্ক দানা বেঁধেছে। কী রকম?
মোক্তার। |
আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য: হাঙ্গামা-সংঘর্ষের মামলাটিতে মোক্তার ও মুন্নাদু’জনেই অভিযুক্ত। বাড়তি হিসেবে মুন্নার বিরুদ্ধে যোগ হয়েছে পুলিশ-খুনের মামলা। “মোক্তার যদি জামিনে ছাড়া পেয়ে সাক্ষীদের ভয় দেখাতে পারেন, তা হলে মুন্না তা করতে পারবেন না কেন?” প্রশ্ন এক আইনজীবীর। একই সুরে সিপিএম নেতা রবীন দেবের আক্ষেপ, “এ রাজ্যে যারা অপরাধী, তারা অনেক ক্ষেত্রে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। শাস্তি পাচ্ছেন আক্রান্তেরা!” রবীনবাবুর অভিযোগ, “সরকার দ্বিচারিতা করছে। খুনের মতো গুরুতর মামলায় অভিযুক্তের জামিনের বিরোধিতা করছে না! অথচ তুলনায় কম গুরুতর মামলায় অভিযুক্তের জামিনের বিরোধিতা হচ্ছে।” সমালোচনার সুর আর এক ধাপ চড়িয়ে কংগ্রেস
নেতা তথা রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, “এখন সবার নজর সারদা-কাণ্ডের দিকে। সেই সুযোগে সরকার নির্লজ্জের মতো আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুলিশ-খুনের অভিযুক্তকে ছেড়ে দিল!”
সরকারি তরফের বক্তব্য কী?
রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী তথা বন্দরের তৃণমূল বিধায়ক ফিরহাদ হাকিমের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “আইন আইনের পথেই চলবে।”
এ দিকে ৭৭ দিনের বন্দিদশা কাটিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ছাড়া পেয়েই মুন্না হাসপাতালে গিয়েছিলেন অসুস্থ মাকে দেখতে। তার পরে তিনি রাজনৈতিক কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে রাতেই তিনি বন্দরের তৃণমূল নেতা সিরাজুল করিম (বাবলু)-কে সঙ্গে নিয়ে পুরসভার ওয়ার্ড অফিসে বসেন, কর্মী-সমর্থকদের কাছে এলাকার নানা বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। এ দিন দুপুরে গার্ডেনরিচের আয়রনগেট রোডের বাড়ির কিছু দূরে মসজিদে যান জুম্মার নমাজ পড়তে। পরে নিজের ব্যবসায়িক অফিসে বসে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। দলীয় কর্মীদের সঙ্গেও আলোচনা করেন। বৃহস্পতিবার যে বলেছিলেন, রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা বলবেন না?
এ দিন মুন্নার ব্যাখ্যা, “আমি এখনও কাউন্সিলর। এলাকার উন্নয়নের কাজ তো করতেই হবে! তা ছাড়া আমি ফিরতেই স্থানীয় মানুষ নানান আর্জি নিয়ে হাজির হচ্ছেন। সে সব সামাল দিচ্ছি।” তৃণমূলের হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত থাকবেন কি?
“সেটা দল ঠিক করবে। আমি দলের নির্দেশ পালন করব।” ঘোষণা মুন্নার। |