মা গুরুতর অসুস্থ। সাতাত্তর দিন হেফাজতে থাকার পরে এই যুক্তি দেখিয়ে বৃহস্পতিবার জামিন পেয়ে গেলেন গার্ডেনরিচে পুলিশ-হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত, তৃণমূল কাউন্সিলর মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না। আর্জিতে আপত্তি জানায়নি সরকারপক্ষ, যা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতেও দেরি হয়নি।
আলিপুর জেলা ও দায়রা জজের আদালত এ দিন মুন্নার জামিন মঞ্জুর করেছে। আবেদনের শুনানিতে রাজ্য সরকারের তরফে সরকারি কৌঁসুলি শ্যামাদাস গঙ্গোপাধ্যায় আদালতে জানান, অভিযুক্তের মায়ের শারীরিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি আর্জির বিরোধিতা করতে চান না। কিন্তু রাজ্য সরকার এ ভাবে খুনের মামলার অন্যতম অভিযুক্তের জামিনের বিরোধিতা না-করায় আইনজীবী ও রাজনৈতিক মহলের একাংশে প্রশ্ন উঠেছে। কী রকম?
খুনের অভিযোগ না-থাকা সত্ত্বেও গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে অভিযুক্ত যে কংগ্রেস নেতা এখনও জামিন পাননি, সেই মোক্তারের কৌঁসুলি তুলসী মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “মুন্নার মায়ের অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে জামিন চাওয়া হল, সরকার আপত্তি করল না! অথচ মোক্তারের বাবার অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আমিও জামিনের আবেদন করেছিলাম। তখন কিন্তু সরকারপক্ষের বিরোধিতাতেই তা নামঞ্জুর হয়ে গিয়েছে।” |
তাঁর আরও প্রশ্ন, “মোক্তার যে মামলায় (হাঙ্গামা ও সংঘর্ষ) অভিযুক্ত, সেই মামলায় মুন্নারও নাম রয়েছে। সেই মামলায় চার্জশিট হওয়ার আগেই মুন্না জামিন পেলেন কী করে?” প্রসঙ্গত, গত ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র-ভোটের মনোনয়ন ঘিরে ওই গণ্ডগোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরী। ঘটনায় ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বরোর তদানীন্তন চেয়ারম্যান মুন্নার নাম জড়িয়ে যায়। দু’দিন পরে মুন্না গা ঢাকা দেন। ৭ মার্চ বিহারের ডেহরি-অন শোনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ-খুনের মামলাটিতে অবশ্য মুন্নার নামে চার্জশিট জমা পড়েছে।
প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরাও। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “আদালত জামিন দিয়েছে, তা নিয়ে কিছু বলা যায় না। কিন্তু সরকার জামিনের বিরোধিতা করেনি। ঘটনার ক’দিন পরে মুখ্যমন্ত্রী তো তাপস চৌধুরীর পরিবারের কাছে গিয়েছিলেন। পরিবারটি তখন বিচার ও নিরাপত্তার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীকে কিছু আর্জি জানিয়েছিল। সেই কথাগুলো ওঁদের (সরকারের) বিবেকে জাগে কি না, বলতে পারব না। তবে সরকারের কাজকর্ম দেখে তো মনে হয়, ওঁদের কিছু মনে নেই!” এ প্রসঙ্গে শিলিগুড়ির ডিওয়াইএফআই নেতার উদাহরণও টেনে এনেছেন সিপিএম নেতারা। তাঁদের দাবি: কিছু দিন আগে ওই নেতা গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর মা মারা
গিয়েছিলেন। খুন বা খুনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগও ছিল না। তবু মায়ের শেষকৃত্যের জন্য ওঁকে প্যারোলেও ছাড়া হয়নি, সরকারি আইনজীবীও আর্জির পক্ষে দাঁড়াননি।
এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএম নেতৃত্বের প্রশ্ন, শাসক-বিরোধী বিচারে সরকারের ভূমিকা বদলে কি বদলে যাচ্ছে? পাশাপাশি মুন্নার জামিনের খবরে বেহালায় তাপসবাবুর পরিবারও আতঙ্কে। “সরকারের উপরে আস্থা রেখেছিলাম। একা ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকি। এতে আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না তো?” এ দিন শঙ্কা ঝরে পড়েছে তাঁর স্ত্রী মিনতিদেবীর কথায়।
গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়ার পরে এত দিন একাধিক বার মুন্নার জামিন নাকচ হয়েছে। বুধবার মায়ের অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কৌঁসুলি মারফত আলিপুর কোর্টে তিনি জামিনের আবেদন করে জানিয়েছিলেন, তাঁর মা শওকত খানের চিকিৎসা চলছে এক বেসরকারি হাসপাতালে। এ অবস্থায় তাঁর মায়ের কাছে থাকা জরুরি। আর্জি শুনে কোর্ট সিআইডি-কে নির্দেশ দেয়, হাসপাতালে গিয়ে মুন্নার মায়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে রিপোর্ট দিতে।
সিআইডি বিন্দুমাত্র দেরি করেনি। সিআইডি-র এক ইন্সপেক্টর সে দিনই হাসপাতালে গিয়ে মুন্নার মায়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নেন। এ দিন সিআইডি কোর্টকে রিপোর্ট দেয়। মুন্নার কৌঁসুলি অশোক মুখোপাধ্যায়ও এ দিন আদালতকে জানান, মুন্নার মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে, তিনি এখন ভেন্টিলেশনে। অশোকবাবু সওয়ালে এ-ও বলেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে পুলিশ আগেই চার্জশিট জমা দিয়েছে, অর্থাৎ, খুনের মামলা নিয়ে পুলিশের কোনও তদন্ত বাকি নেই। তাই মুন্নাকে জামিন দেওয়া হোক। সরকারি তরফে আপত্তি না-থাকায় ভারপ্রাপ্ত বিচারক শ্যামসুন্দর চট্টোপাধ্যায় শর্তসাপেক্ষে মুন্নার জামিন মঞ্জুর করেন। বিচারকের নির্দেশ: ফের কোনও আদেশ না-দেওয়া পর্যন্ত মুন্নাকে ফি সপ্তাহে এক বার সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
এ দিকে সরকারপক্ষ মুন্নার জামিনের বিরোধিতা না-করায় কলকাতা পুলিশের একটি বড় অংশের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই মহলের আক্ষেপ, কলকাতার পুলিশ কমিশনার স্বয়ং তাপসবাবুর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বাহিনীর মনোবল বাড়লেও এ দিনের ঘটনায় তা আবার ধাক্কা খেল। ঘটনাচক্রে, বুধবার রাতেই বদলি করা হয়েছে গার্ডেনরিচ থানার ওসি-কে, যিনি কিনা মুন্নার অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলে পুলিশের একাংশের দাবি। লালবাজারের কর্তাদের অবশ্য ব্যাখ্যা: এটা নিতান্তই কাকতালীয়, ওসি-বদলির সঙ্গে মুন্নার জামিনের কোনও সম্পর্ক নেই।
এ দিন সন্ধে সাতটা নাগাদ আলিপুর প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার থেকে ছাড়া পেয়ে মাকে দেখতে হাসপাতালে যান মুন্না। জামিন-বিতর্ক প্রসঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “কোর্ট জামিনে মুক্তি দিয়েছে। মা অসুস্থ। রাজনীতি নিয়ে কিছু বলব না।”
|