|
|
|
|
লিগ খেতাবের হ্যাটট্রিক করেও মর্গ্যানের উদাস হাসি
|
রতন চক্রবর্তী • কলকাতা |
ইস্টবেঙ্গল-৩ (চিডি-২, পেন)
মোহনবাগান-২ (ওডাফা, টোলগে) |
দু’হাত মাথার উপর তুলে হাততালি দিতে দিতে ট্রেভর জেমস মর্গ্যান যখন বিদায় নিচ্ছেন তখন যুবভারতীর জমাট লাল-হলুদ গ্যালারি কাগজের মশাল জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে।
কোচের থেকে যাওয়ার আব্দারের অদৃশ্য পোস্টার ঝুলছিল শুরু থেকেই। ম্যাচ শেষে সেটাই স্লোগান হয়ে আছড়ে পড়ল কলকাতা লিগ জয়ের হ্যাটট্রিক করা কোচের উপর।
সাহেব কোচ সে দিকে তাঁকিয়ে হাসছিলেন। উদাস হাসি।
ড্রেসিংরুম থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করতে আসার মর্গ্যানের পায়ে পুলিশের কড়া নজর এড়িয়ে ঝাঁপাল লাল-হলুদ জনতা। মাথায় ঢেলে দেওয়া হল বোতলের জল। এ দেশে তাঁর শেষ বার পরা আকাশি-নিল জার্সিটা ভিজে সপসপে। |
গোলের পরে অবশ্য অন্য মেজাজ। ছবি: উৎপল সরকার |
ব্রিটিশ কোচ তখনও উদাসীন। গায়ের জার্সিটা দেখাতে দেখাতে কিছুটা নস্ট্যালজিক হলেন মর্গ্যান। “এ রকম মুহূর্ত কোনও মানুষের জীবনে খুব কমই আসে। আমার হৃদয়ে এটা চির দিন থেকে যাবে।”
কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে মর্গ্যানের ছত্রিশ মাসের সফল কোচিং জীবনের শেষ দিনের মঞ্চে বাকিরা কোথায়? ভারতে আসার পর যাঁদের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন মর্গ্যান। ভাগ করে নিয়েছেন ঘণ্টা, সেকেন্ড, মিনিটের সুখ-দুঃখ? ম্যাচ শেষে কোথায় তাঁরা! চিডি, মেহতাব, উগা, পেনরা....! মর্গ্যান-ব্রিগেডের ফুটবলাররা। কোথায়ই বা লাল-হলুদ কর্তারা? দলকে শেষ ডার্বিতেও জেতানোর পরেও মাঠে মর্গ্যানের আশেপাশে কেউ কোথাও নেই! একটা ফুল দূরের কথা, আটটা ট্রফি দেওয়ার পরেও ‘টিম ইস্টবেঙ্গলের’ শুভেচ্ছার একটা হাতও এগিয়ে এল না তাঁর জন্য। একমাত্র ব্যতিক্রম পুরনো শিষ্য, এখন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বাগান স্ট্রাইকার টোলগে। যাঁকে ভারতে এনেছিলেন মর্গ্যানই। যাঁকে জড়িয়ে ধরে টোলগে বলে গেলেন, “ট্রেভর, আই মিস ইউ।”
ক্লাব ছেড়ে যাওয়া কোচের প্রতি লাল-হলুদ শিবিরের অবাক নিস্পৃহতা উসকে দিচ্ছে ৪৪ বছর আগের এ রকমই এক ময়দানি ঘটনা। ১৯৬৯-এ লিগ জেতার পর ইডেনে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে শিল্ড চ্যাম্পিয়নও হওয়ার পর মোহনবাগান তাঁবুতে ফিরে কোচ অমল দত্ত আশ্চর্য হয়ে দেখেছিলেন, কর্তারা সব দরজা-জানলা বন্ধ করে বাড়ি চলে গিয়েছেন। “আমি রাত দশটা পর্যন্ত মালিদের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম। দ্বিমুকুট জিতেও চাকরি গিয়েছিল আমার,” প্রবীণ কোচের স্মৃতিতে এখনও অক্ষয় সেই ঘটনা। মর্গ্যান অবশ্য নিজেই ছেড়ে যাচ্ছেন ক্লাব। ইস্টবেঙ্গল ফুটবল সচিবের ‘থেকে যাওয়ার’ অনুরোধ উপেক্ষা করে।
ব্রিটিশরা আবেগপ্রবণ হন না। যে কোনও বড় সাফল্যেই থাকেন নিস্পৃহ। এটা প্রচলিত প্রবাদ। গত তিন বছর সেটা মেনে এসেছেন একদা হাল সিটি-র ডেভেলপমেন্ট কোচ। কিন্তু বৃহস্পতিবার তিনিই ছিলেন ব্যতিক্রমী। গোলের পর তাঁকে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়তে দেখা গেল আকাশের দিকে। কখনও মাঠের দিকে মুঠি উড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘ইয়েস’। ম-র্গ্যা-ন, ম-র্গ্যা-ন চিৎকার শুনে পালটা হাত নাড়ালেন। |
|
এত দিন পরিচিত দৃশ্য ছিল ম্যাচ শেষ হওয়ার পর গটগট করে মর্গ্যান বিপক্ষ কোচের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এ দিন তা-ও বদলে গেল। যুবভারতীতে ডার্বি এবং কলকাতা লিগ জয় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মর্গ্যান দ্রুতগতিতে ঢুকে পড়লেন মাঠে। প্রত্যেক ফুটবলারের সঙ্গে হাত মেলালেন। বুকে জড়ালেন। তার পর পা বাড়ালেন টানেলের দিকে। ফুটবলাররা অবশ্য ততক্ষণে গ্যালারির দিকে ভিকট্রি ল্যাপের দৌড় লাগাতে ছুটেছেন।
মর্গ্যানের প্রতি এই নিস্পৃহতা তাঁর বিদায়ী প্রাপ্য ছিল কি না হয়তো সময় বলবে। “কলকাতায় এক জন বিদেশি কোচ তিন বছর কোচিং করাচ্ছে এবং শেষ দিনে গ্যালারি একযোগে তাঁর জন্য চেঁচাচ্ছে। এটা প্রমাণ করে আমি তা হলে কিছু করেছি,” বললেন দলের পারফরম্যান্সে তৃপ্ত মর্গ্যান স্বয়ং। তিনি যে কিছু করেছেন, সেটা প্রমাণ করার জন্য সম্ভবত সেরা মঞ্চকেই বেছে নিয়েছিলেন বিদায়ী ইস্টবেঙ্গল কোচ। শুধু ট্যাকটিক্স আর মগজাস্ত্র প্রয়োগ করে মর্গ্যান শেষ ডার্বিতেও রিং-এর বাইরে পাঠিয়ে দিলেন করিম বেঞ্চারিফা আর তাঁর সাধের বাগানকে।
নিখুঁত এবং চমকপ্রদ স্ট্র্যাটেজি। হয়তো কিছুটা ঝুঁকিরও। ওয়ান স্ট্রাইকার চিডিকে রেখে চারিদিক থেকে পেন, লোবো,লালরিন্দিকাদের কম্পাস মাপা কোণাকুনি দৌড়। কখনও ত্রিভুজ, কখনও চতুর্ভুজ হয়ে যা বোকা বানিয়ে দিল বাগান ডিফেন্সকে। তুলল ঝড়। ২৪ থেকে ২৮ চার মিনিটের মধ্যেই মর্গ্যান-২, করিম-০।
ওডাফার জন্য বরাদ্দ ছিল জোনাল মার্কিং। যা চক্রব্যুহ হয়ে দেখা দিচ্ছিল মাঝেমধ্যে। আনফিট টোলগে থপথপ করে দৌড়োচ্ছিলেন। তার জন্য আলাদা কোনও স্ট্র্যাটেজিও তৈরি করেননি চতুর লাল-হলুদ কোচ। কিন্তু ওডাফা মোহনবাগানকে ট্রফি দিতে না পারুন, তিনি গোল করতে পারেন। সেটা প্রমাণ করলেন এ দিনও। প্রায় পঁচিশ গজ দূর থেকে অসাধারণ একটা গোল করলেন সোয়ার্ভিং ফ্রি কিকে। এতে ম্যাচটা ২-১ হল, কিন্তু মোহনবাগান জাগল না। জাগবেই বা কী করে? করিমের টিম তো পুরো ম্যাচেই দিশাহারা। আগোছাল। পরিকল্পনাহীন। ইচে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরে চলে যাওয়ার পর রক্ষণ খাবি খেতে শুরু করল। মাঝমাঠে ডেনসন, মণীশ, সাবিথরা নির্বিষ। ফলে লাল-হলুদ সুনামি থামল না। চিডি এবং পেনের দু’টো শট পোস্টে লেগে ফেরার পর মনে হচ্ছিল ডার্বিতে আবার একটা ৪-১ বা ৫-১ হওয়ার স্মৃতি হয়তো ফিরবে। সেটা হয়নি ঠিক। উল্টে উপভোগ্য ম্যাচ কিছুটা অপ্রত্যাশিত ফল নিয়েই শেষ হল। চিডি ফের ৩-১ করার পর টোলগের ইনজুরি টাইমের গোলে ৩-২। করিম যাকে বলছেন, “ভদ্রস্থ ফল।”
ইস্টবেঙ্গলের পরবর্তী কোচ কে হবেন তা দু’-এক দিনের মধ্যেই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। শেষ দিনে ব্রাত্য হয়েও মর্গ্যান কিন্তু বলে গেলেন, “যেখানেই থাকি আমার প্রিয় দল ওয়েস্ট হ্যামের পর গুগুল সার্চ করে ইস্টবেঙ্গলের কথাই জানার চেষ্টা করব।”
সত্যিকারের পেশাদাররা মনে হয় এ রকমই হন!
|
ইস্টবেঙ্গল:
অভিজিৎ, নওবা, উগা (গুরবিন্দর), অর্ণব, সৌমিক, মেহতাব, পেন, লোবো, লালরিন্দিকা (সঞ্জু), ইসফাক, চিডি (বরিসিচ)।
মোহনবাগান:
শিল্টন, নির্মল, ইচে (মণীশ ভার্গব), আইবর, বিশ্বজিৎ, মণীশ মৈথানি (রাকেশ), সাবিথ, নবি (মেহরাজ), ডেনসন, ওডাফা, টোলগে।
|
পুরনো খবর: এই মরসুমটাই ইস্টবেঙ্গলে সেরা, বলছেন মর্গ্যান |
|
|
|
|
|