আম-লিচুর ঝুড়ি। পাঞ্জাবির বাক্স। রসগোল্লার হাঁড়ি। ফুলের তোড়া ও স্মারক।
ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের বিদায়ী সংবর্ধনায় লাল-হলুদ সমর্থকদের উপহারের ডালায় উপকরণের অভাব ছিল না। কিন্তু সাড়ে পাঁচ ফুটের একটা ‘জ্যান্ত’ ইলিশ নিয়ে যাঁরা যুবভারতীর গেটের বাইরে উদ্দাম নাচছিলেন, বৃহস্পতিবার ম্যাচ শেষে সব ছেড়ে ছুড়ে তাঁদের দিকে এক বার চোখ বুলিয়ে নিলেন ইস্টবেঙ্গল কোচ। তার পরে একটা মুচকি হাসি দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে সোজা ড্রেসিংরুমে! কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে সম্ভবত ওই এক বারই ব্রিটিশ কোচের হাসিমুখ দেখতে পাওয়া গেল! মাঠে বাদবাকি সময়টা তিনি নির্বিকার! নিরুত্তাপ!
লাল-হলুদ কোচের বহিরঙ্গ দেখলে অবশ্য অন্দরমহলের ছবিটা বোঝার উপায় নেই। সমর্থকদের ঠেলাঠেলি, ভিড়-ভাট্টার মধ্যে ভিতরের উচ্ছ্বাসটা জনসমক্ষে চাপা পড়ে গেলে কী হবে? ড্রেসিংরুমের আবহাওয়া ছিল একেবারেই আলাদা। লিগ জয়ের সেলিব্রেশনের আসল দৃশ্য ফুটে উঠল তখনই, যখন পেন ও ইসফাক এক বালতি জল উলটে দিলেন মর্গ্যানের মাথায়। জলে ভেজা মর্গ্যানও ছাড়লেন না পালটা দিতে। খালি বালতি নিয়েই ছুটলেন পেনের পিছনে। জল না পেয়ে বালতিটাই পরিয়ে দিলেন নাইজিরিয়ান মিডিওর মাথায়। চলল উদ্দাম হাসি-ঠাট্টা। সব শেষে কানফাটা চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যেই লাল-হলুদ ফুটবলাররা সবাই কোলাকুলি করে বিদায়ী সংবর্ধনা দিলেন প্রিয় কোচকে। পেন বলছিলেন, “মর্গ্যান আমার দেখা সেরা কোচ। ফুটবলারদের এত ভাল বুঝতেন যে বলার নেই। খারাপ সময়ে ওঁর অনুপ্রেরণাতেই ফের উঠে দাঁড়িয়েছি।” |
বিদায়বেলায় টোলগেকে পাশে পেলেন মর্গ্যান। ছবি: উৎপল সরকার |
তিন বছরে মোট আটটা ট্রফি। সাম্প্রতিককালে ভারতের ক্লাব-ফুটবলে কোনও বিদেশি কোচ এত সাফল্য পেয়েছেন কি না মনে করা যাচ্ছে না। তবু বিদায়বেলায় ট্রফি হাতে নিয়েও পুরোদস্তুর পেশাদারি মনোভাব সরিয়ে সর্বসমক্ষে মুখোশ খুলতে পারলেন না মর্গ্যান। শুধু বলে গেলেন, “এটা আমার কোচিং জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত। আজ সারা রাত বিয়ার খাব আর উৎসব করব।”
ইস্টবেঙ্গলে মর্গ্যান-যুগ শেষ তবু এই সত্যিটা যেন কোনও ফুটবলারই মেনে নিতে পারছেন না। কলকাতা ডার্বির জোড়া গোলদাতা চিডি যেমন বলে গেলেন, “মর্গ্যানের সঙ্গে এক কাপ কফি খাওয়াটা খুব মিস করব। তাও কোচের বিদায়ী ম্যাচে যে জয় উপহার দিতে পারলাম, এটাই স্বস্তির। আমার একটা গোল মর্গ্যানকে উৎসর্গ করছি। আর একটা গোল আমার সদ্যোজাত মেয়েকে।” মেহতাব বলছিলেন, “এক জন বন্ধুকে খুব মিস করব। সাফল্যের দিনে তো সবাই পাশে থাকে। বিপদের দিনে কিন্তু মর্গ্যানকেই সবার আগে পাশে পেয়েছিলাম।”
কলকাতা ডার্বির ইতিহাসে আগে যা কখনও ঘটেনি, বৃহস্পতিবার সেটাই দেখল যুবভারতী। জিতেও অঝর কান্নায় ভেঙে পড়লেন লাল-হলুদ সমর্থকেরা। মর্গ্যানের বিদায় যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁরাও! মর্গ্যানের গাড়ি ঘিরে কেউ কাঁদছেন, কেউ আবার তাঁর পা ধরে অনুনয় করছেন। কোনও রকমে স্টেডিয়ামের করিডরে সমর্থকদের ‘অত্যাচার’ থেকে মুক্তি পেয়ে যে নিজের ফ্ল্যাটে যাবেন, তারও উপায় নেই। গাড়ির সামনে গিয়ে দেখেন, ড্রাইভারের পাত্তা নেই। মিনিট পনেরো হন্তদন্ত হয়ে খোঁজার পরে অবশেষে গাড়িচালকের সন্ধান পেলেন। কিন্তু ততক্ষণে যে ভিড় উপচে পড়েছে তাঁর গাড়ির উপর। অবশেষে পুলিশের সাহায্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
মর্গ্যানকে ঘিরে বৃহস্পতিবারের যুবভারতী বাঁধনভাঙা আবেগে রীতিমতো উত্তাল হয়ে ওঠে! চিডির জোড়া গোল, লিগের ট্রফি সবই কিছুটা ঢাকা পড়ে গেল যার আড়ালে। এখন দেখার, ফুটবলার-সমর্থকদের এত ভালবাসা মর্গ্যানসাহেবের হৃদয়কে নাড়া দিতে পারে কি না! |