সারদা গোষ্ঠীর ডিভিশনাল ম্যানেজার অরিন্দম দাস ওরফে বুম্বার বিরুদ্ধে সংস্থার মালিকানা হাতিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ তুলেছিলেন সুদীপ্ত সেন। এ বার বুম্বার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ তুললেন সংস্থার অন্যতম কর্ত্রী দেবযানী মুখোপাধ্যায়ও। পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, বুম্বার পরামর্শে ইএম বাইপাস এলাকায় কয়েক কোটি টাকায় ১৮ বিঘা জমি কিনেছিল সারদা। কিন্তু পরে সুদীপ্তের সই জাল করে বুম্বা তা নিজের নামে করে নেন বলে দেবযানীর অভিযোগ।
সুদীপ্ত-দেবযানী দু’জনেই বুম্বার ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইলেও তাঁদের এবং ধৃত অন্য দু’জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা (অর্থ সংস্থার মালিক বা এজেন্ট দ্বারা বিশ্বাসভঙ্গ) যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে বিধাননগর এসিজেএম আদালত। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত সাজা হতে পারে।
সারদার কর্মীদের বেতন সংক্রান্ত তিনটি মামলায় সুদীপ্ত-সহ ধৃতদের বিরুদ্ধে ওই ধারা প্রয়োগ করতে চেয়ে আগেই আর্জি জানিয়েছিল প্রশাসন। বৃহস্পতিবার তার শুনানিতে সরকার পক্ষের আইনজীবী সাবির আলি বলেন, ডিরেক্টরেরা এজেন্টদের কাজ দেখাশোনা করতেন। সংস্থার বহু দায়িত্বও ন্যস্ত ছিল তাঁদের উপরে। তাই এই ধারাটা তাঁদের ক্ষেত্রে খাটে। সংস্থার কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও জমা দেওয়া হয়নি। এই ধারা প্রয়োগের বিরোধিতা করেন অভিযুক্তদের আইনজীবী। দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক মামলায় ওই ধারা যুক্ত করার নির্দেশ দেন।
সুদীপ্তদের বিরুদ্ধে কঠোরতর এই ধারা প্রয়োগের পাশাপাশি সারদা কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত বুম্বার খোঁজ চলছে পুরোদমে। তাঁর হদিস পেতে সুদীপ্ত-দেবযানীকে দফায় দফায় জেরা করে চলেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের কর্তারা।
বুম্বা সম্পর্কে পুলিশকে কী বলেছেন দেবযানী?
পুলিশি সূত্রের খবর, বারুইপুরের ফুলতলার একটি বাগানবাড়িতে মাঝেমধ্যেই মোচ্ছব করতেন বুম্বা। জেরায় দেবযানী জানিয়েছেন, তাতে হাজির থাকতেন শাসক দলের প্রভাবশালী নেতারাও। থাকতেন স্থানীয় এক তৃণমূল কাউন্সিলরও। তিনি জমি কেনার ব্যাপারে সারদাকে সাহায্য করতেন বলেও জানিয়েছেন দেবযানী। পুলিশের কাছে সুদীপ্ত দাবি করেছেন, অসম-ত্রিপুরাতেও জমি কেনার কাজে সাহায্য করেছিলেন বুম্বা। এক পুলিশকর্তা বলেন, “সুদীপ্ত শাসক দলের সঙ্গে বুম্বার ঘনিষ্ঠতার কথা বলেছিলেন। এ বার একই সুর মিলল দেবযানীর গলাতেও।”
গোয়েন্দাদের জেরায় দেবযানী বলেছেন, ২০০৮ সালে আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সারদা গার্ডেনে ১৩৫টি আবাসন তৈরি করা হবে বলে সংস্থার ডিরেক্টরদের জানিয়েছিলেন সুদীপ্ত। কিন্তু ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই সুদীপ্ত আবাসন ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আবাসন প্রকল্পের বদলে সারদা গার্ডেন হয়ে ওঠে শাসক দলের নেতাদের আড্ডার জায়গা। আবাসন ব্যবসায় আগ্রহ হারানোর ফলে অর্থ লগ্নি সংস্থার ব্যবসাই সুদীপ্তের মুখ্য লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ২০১১ সালের পর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে বেহিসেবি অর্থ বিনিয়োগ শুরু করেন তিনি।
দেবযানীর দাবি, ২০১০ সাল থেকে তিনি সংস্থার ‘ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা’র প্রধান হলেও অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদীপ্ত একাই সিদ্ধান্ত নিতেন। দেবযানীর বক্তব্য, সংস্থার ভরাডুবির সময় তিনি সংস্থার আর্থিক লেনদেনের দায়িত্বে ছিলেন না। এক তদন্তকারী অফিসার জানান, মাস চারেক আগে ওই দায়িত্ব সুদীপ্তের দ্বিতীয় স্ত্রী পিয়ালিকে দেওয়া হয়েছিল বলে দেবযানীর দাবি। তিনি বলেন, আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি জানতেন সুদীপ্তের এক ব্যক্তিগত সচিবও।
তদন্তকারীদের একাংশ সারদার আর্থিক লেনদেন নিয়ে দেবযানীর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেই জন্যই পিয়ালির খোঁজ করছে পুলিশ। সুদীপ্ত ধরা পড়ার পর থেকেই পিয়ালি-সহ তাঁর পরিবারের লোকেরা ফেরার। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, তাঁরা ভিন্ রাজ্যে রয়েছেন। যদিও তাঁদের হাতে বেশি পরিমাণে টাকা নেই বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।
এই বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে সুদীপ্তের আইনজীবী সমীর দাসের কথাতেও। এ দিন বিধাননগর আদালতে একটি আবেদন করে তিনি জানান, সুদীপ্তের ব্যক্তিগত এবং তাঁর পরিবারের অ্যাকাউন্ট (যার মধ্যে তাঁর দুই স্ত্রী ও ছেলের অ্যাকাউন্ট রয়েছে) বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সেগুলি খুলে দেওয়া হোক। সরকারি আইনজীবী অবশ্য জানান, এই ধরনের কোনও অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। বিচারক প্রশ্ন তোলেন, সমীরবাবুর আগের বক্তব্য অনুযায়ী সুদীপ্ত সেনের কোনও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট নেই। তা হলে তিনি এ কথা বলছেন কেন? পরে দু’পক্ষের কথা শুনে সুদীপ্তের পরিবারের অ্যাকাউন্টগুলির কী অবস্থা, জানতে চেয়েছে আদালত।
বুধবার, হাজিরার দিন দেবযানীকে কেন আদালতে তোলা হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁর আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা। এ ব্যাপারে দমদম জেলের সুপারকে একটি রিপোর্ট পাঠাতে বলেছিল আদালত। এ দিন জেল সুপার রিপোর্ট পাঠালেও তাতে সন্তুষ্ট হননি বিচারক। তিনি সুপারকে সশরীরে হাজির হয়ে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
|