সংখ্যায় ওঁরা প্রায় পাঁচ হাজার। চাপের মুখে সারদায় টাকা রেখেছিলেন। কষ্টার্জিত দু’কোটি টাকা স্রেফ ডুবে গিয়েছে।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ গত কয়েক দিনে সোনাগাছির যৌনপল্লিতে সমীক্ষা চালাচ্ছিলেন। প্রাথমিক ভাবে এ রকমই একটি হিসাব পেয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে অনেকে ওই সমবায় ব্যাঙ্ক থেকেই টাকা তুলে বিনিয়োগ করেছিলেন সারদায়। অনেকেই সারা জীবনের সঞ্চয় খুইয়ে এখন কার্যত সর্বস্বান্ত। রাজ্য জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ সারদায় টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে একটা ফারাক আছে সোনাগাছির এই প্রান্তিক মহিলাদের।
কী ফারাক? সোনাগাছির মহিলারা বেশির ভাগই দালালদের চাপের মুখে পড়ে সারদায় টাকা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে অভিযোগ। সোনাগাছির বাসিন্দা উমাদেবী বলেন, “অন্য সবাই সারদায় টাকা রেখেছিলেন বেশি সুদের আশায়। আমাদের এখানেও বেশি সুদের লোভ তো ছিলই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ভয়।” ভয় কেন? উমাদেবী বলেন, “সারদায় টাকা জমা না দিলে আমাদের কাজ বন্ধ করে দিত এলাকার কিছু প্রভাবশালী দালাল। প্রতিদিন টাকা নিতে আসত ওরা। ওদের চটিয়ে তো এখানে কাজ করতে পারব না।” দালালদের উপদ্রব থেকে বাঁচতে উমাদেবী প্রায় ৯ লক্ষ টাকা জমা রেখেছিলেন সারদায়। টাকা পাওয়ার জন্য এখন শ্যামল সেন কমিশনে আবেদন জমা দিয়েছেন তিনি। উমাদেবী বলেন, “গতর খাটিয়ে আয় করা টাকা এ ভাবে লোপাট হয়ে গেলে কার সহ্য হয়!”
উমা একা নন। সিতারা দাস প্রতিদিন ৫৩০ টাকা করে জমা দিতেন সারদার এক এজেন্টের কাছে। প্রায় ১৫ মাস ধরে প্রতিদিন এই টাকা দিয়ে গিয়েছেন। চাপে পড়ে সারদায় ফিক্সড ডিপোজিটও করেছিলেন দেড় লক্ষ টাকা। অথৈ জলে পড়েছেন তিনি। বলেন, “ভেবেছিলাম, ওদের মাধ্যমে সারদায় টাকা জমা রাখলে এলাকায় নিশ্চিন্তে কাজ করা যাবে। এ রকম হবে ভাবিনি।” সোনাগাছির বাসিন্দাদের অভিযোগ, কথা না শুনলে নানা অছিলায় ঝামেলা বাধাত দালালরা। ঘরে লোক ঢুকতে বাধা দিত। সেই ঝামেলা এড়াতে ওঁরা টাকা রেখেছিলেন সারদায়। এখন তার চেয়েও বড় বিপদ এসে উপস্থিত হয়েছে।
এক অবস্থা জুলিয়ারও। বছর তিনেক আগে সোনাগাছিতে আসার পর স্থানীয় সমবায় ব্যাঙ্কে ‘দৈনিক জমা প্রকল্পে’ তিনশো টাকা করে দিতেন। সমবায় ব্যাঙ্কেরই এক এজেন্ট তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতেন। জুলিয়া বলেন, “ওই এজেন্টের সঙ্গে কয়েক জন দালাল এসে আমাকে সারদায় টাকা রাখার জন্য চাপ দিতে থাকে। প্রথমে আমি ওদের মাধ্যমে টাকা জমাতে রাজি হইনি। কিন্তু এর পরেই নানা অত্যাচার শুরু করে ওই দালালেরা।” জুলিয়ার অভিযোগ, দালালদের অত্যাচারে তাঁর কাজ ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। তিনি বলেন, “এক রকম বাধ্য হয়েই সারদায় বই খুলেছিলাম।”
উমাদেবী, সিতারা বা জুলিয়ার মতো অনেকই বাধ্য হয়ে সারদায় টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন সোনাগাছির হাজার পাঁচেক যৌনকর্মী। সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার শান্তনু চট্টোপাধ্যায় জানান, গত তিন বছরে তাঁদের ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা তুলে সারদায় জমা রেখেছিলেন যৌনকর্মীরা। তার উপরে আরও কিছু খুচরো সঞ্চয় মিলিয়ে মোট টাকার পরিমাণ দু’কোটির কাছে পৌঁছেছিল। সমবায় ব্যাঙ্কের দৈনিক জমা প্রকল্পের বেশ কিছু এজেন্টও সারদার হয়ে সোনাগাছি থেকে জোর করে টাকা তুলতেন বলে অভিযোগ পেয়েছিলেন শান্তনুবাবু। তিনি বলেন, “চার জন সংগ্রহকারীকে চিহ্নিত করে আমরা তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিলাম। সোনাগাছির ঘরে ঘরে গিয়ে অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রাখার বিপদের কথাও বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বিশেষ কাজ হয়নি।”
শুধু সোনাগাছিও নয়। রাজ্যের অন্যান্য যৌনপল্লি থেকেও সারদার এজেন্টরা বহু টাকা তুলেছেন বলে জানিয়েছেন যৌনকর্মীদের সংগঠন, দুর্বার-এর সম্পাদক ভারতী দে। তিনি জানান, বৌবাজার, কালীঘাট, আসানসোল, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি, ইসলামপুর, কোচবিহারের যৌনকর্মীরাও লক্ষ লক্ষ টাকা রেখেছিলেন সারদায়। ওই টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য যৌনকর্মীদের আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করতে চলেছে দুর্বার। |