বিরোধী আসনে গিয়ে এ বারই প্রথম পঞ্চায়েত ভোটের মুখোমুখি। কঠিন লড়াইয়ে দলের সৈনিকদের ময়দানে রাখতে কড়া দাওয়াইয়ের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে সিপিএম!
পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কোনও ‘চাপের মুখে’ মনোনয়নপত্র তুলে নিলে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। দলীয় সদস্য-প্রার্থীদের জন্য আগাম এই কঠোর বার্তাই দিয়েছে সিপিএমের রাজ্য কমিটি।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকারের যাবতীয় মতপার্থক্য মিটলে ৯ জুলাইয়ের মধ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোট হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে আর দিনকয়েকের মধ্যেই মনোনয়নপত্র জমার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। ত্রিস্তরে প্রার্থী কারা হবেন, তা নিয়ে প্রাথমিক ঝাড়াই-বাছাই শুরু হয়েছে সিপিএমে। কিন্তু শাসক দলের চোখ রাঙানির জেরে অনেক জায়গাতেই দলের ঘোষিত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন না বলে আশঙ্কা সিপিএম নেতৃত্বের। তবু সংগঠন ধরে রাখতে বহিষ্কারের দাওয়াই ভেবে রেখেছে সিপিএম। দলের এই নির্দেশ সবক’টি জেলা কমিটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কেন এই বার্তা? এ বার পঞ্চায়েতের তিন স্তর মিলে মোট আসন ৫৮ হাজারের বেশি। সিপিএমের একটি সূত্রের বক্তব্য, প্রায় ৫০ হাজার আসনে প্রার্থী দেবে বামফ্রন্ট। এর সিংহ ভাগই সিপিএমের প্রার্থী হবেন। কিন্তু প্রার্থীদের সকলেই দলীয় সদস্য হবেন, এমনটা নয়। দলের এক নেতার কথায়, “বহু আসনেই স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, তরুণ, ছটফটে এবং এলাকায় পরিচিত বাম-মনস্ক মানুষকে প্রার্থী করার কথা ভাবা হয়েছে।” সিপিএম নেতৃত্বের যুক্তি, এই প্রেক্ষাপটে যদি শাসক দলের চাপে ভীত হয়ে দলীয় সদস্য-প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন, তা হলে শুধু সমর্থক-প্রার্থীরা নিজেদের একেবারেই গুটিয়ে নেবেন। দলের এই বাইরের অংশের প্রার্থীদের মনোবল ঠিক রাখতেই দলীয় সদস্য-প্রার্থীদের জন্য বহিষ্কারের খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখছে দল। শাস্তির এই দাওয়াইয়ে সমর্থক-প্রার্থীদের কাছে ‘ইতিবাচক বার্তা’ দেওয়া যাবে বলে মনে করছে দল।
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু হয়েছে ১৯৭৮ সালে। এ পর্যন্ত এ রাজ্যে যতগুলি পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে, সবক’টিতেই শাসক পক্ষে ছিল সিপিএমই। বিরোধী আসনে বসে পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “দীর্ঘ দিন ধরে শাসক দলে থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামে গ্রামে দলের মাতব্বরি তৈরি হয়েছিল। সেটা কিন্তু এ বারের ভোটে নেই। এ বারের ভোটে সঙ্গে থাকবে না প্রশাসনও। বরং, খানিকটা প্রতিকূল অবস্থায় এ বার আমাদের ভোটে লড়তে হবে।”
সিপিএম নেতাদের একাংশের বক্তব্য, পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হয়েছে ৯ এপ্রিল দিল্লিতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে নিগ্রহের ঘটনার পর থেকে। ওই ঘটনার পরে স্রেফ এক দিনেই রাজ্য জুড়ে সিপিএমের প্রায় দেড় হাজার দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে দলের নেতাদের উপরে লাগাতার তৃণমূলের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে সার্বিক ভাবে রাজ্যের বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে সিপিএম অনেকটাই কোণঠাসা হয়েছে। দলের এক নেতার কথায়, “দলের অন্দরে গত অক্টোবর থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু এপ্রিলের ওই ঘটনার পরে ওই তালিকার অনেকেই আর ভোটে দাঁড়াতে চাইছেন না। তাই ওই তালিকা এখন পরিবর্তন করতে হচ্ছে।” তবে দলেরই অন্য একাংশের মত, সারদা-কাণ্ড এসে দিল্লি-কাণ্ডকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থী দিয়ে এখন সারদা-কাণ্ডের ফায়দা তোলার চেষ্টা করতে হবে।
দলীয় সদস্যদের পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ভাবনা রয়েছে সিপিএমে। দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার কারণে বিভিন্ন এলাকায় অনেক মুখ রয়েছে, যারা দলের মধ্যে সক্রিয় হলেও জনমানসে গ্রহণযোগ্য নয়। আবার অনেকে আছেন, যাঁরা দলে সক্রিয় না-হলেও সার্বিক ভাবে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সিপিএমের শীর্ষ স্তরের এক নেতা বক্তব্য, এই দু’ধরনের সদস্যকেই প্রয়োজন। তাই দু’ধরনের সদস্যদের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই প্রার্থী তালিকা তৈরি হচ্ছে।
সিপিএম সব চেয়ে বেশি ফাঁপরে পড়েছে মহিলা সংরক্ষিত আসন নিয়ে। এ বারেই প্রথম পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য ৫০% সংরক্ষণ রেখে ভোট হবে। সিপিএম নেতাদের আশঙ্কা, যে ভাবে শাসক দলের শাসানির সামনে দলের কর্মী-সদস্যরা পিছু হঠছেন, সেখানে মহিলা প্রার্থী খুঁজে দাঁড় করানোই সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনগ্রসরদের জন্য সংরক্ষিত আসনে এই চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। শুধু মহিলা প্রার্থী দাঁড় করানোই নয়, তাঁদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়া নিয়েও চিন্তিত সিপিএম। সেই কারণে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, ভোটের দিন নয়, এ বারের নির্বাচনে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় মনোনয়নপত্র তোলা থেকে জমা দেওয়ার মধ্যের দিনগুলি।
বিডিও-র দফতরের পাশাপাশি মহকুমা শাসকের দফতরে মনোনয়ন জমা দেওয়ারও যাতে ব্যবস্থা করা যায়, তার জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। দলের এক নেতার ব্যাখ্যা, “এর ফলে অনেকে দল বেঁধে মনোনয়ন দাখিল করতে যেতে পারবে। তাতে নিরাপত্তা অনেক বেশি সুনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বিডিও অফিসে ছোট জায়গায় তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।”
পাশাপাশি, মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময়সীমা অবধি প্রার্থীদের ‘সুরক্ষিত’ রাখার বিভিন্ন পরিকল্পনাও নিয়েছে সিপিএম। যদিও সে ব্যাপারে একেবারেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন দলের শীর্ষ নেতারা। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং বর্ষীয়ান বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার কথায়, “অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে যেমন বুঝবে, তেমন করে নেবে। আগে থেকে সব কিছু বলে দিলে তো সবাই জেনে যাবে!” |