জঙ্গলঘেরা পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম। রাতবিরেতে দল বেঁধে হাতি ঢোকা এখানকার চেনা ছবি। লোধা শবরদের ঘুমন্ত পল্লিতে হাতি ঢুকে ঘরদোর ভেঙে তছনছ করছে। গ্রামের মানুষ পাল্টা আক্রমণে গেলেন না। তাঁরা গ্রাম্য দেবতার কাছে শুরু করলেন মানত। সকাল হতেই দেবতার থানে চড়ালেন পুজো। প্রধান উপকরণ মাটির তৈরি হাতির পুতুল। এ ভাবেই হাতি পুতুলের উদ্ভব এবং টিকে থাকা।
বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচতে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি এবং নদিয়ায় পুজো করা হয় বাঘপুতুল। এখানে দক্ষিণ রায়, নারায়ণী এবং বনবিবির পুজোও বহুল প্রচারিত। এরকমই নিঃসন্তান মহিলাদের জন্য ষষ্ঠীপুতুল, বাঘরাই, হাতিবোঙা প্রভৃতি পুতুলের জন্ম।
|
১৮ মে বিশ্ব সংগ্রহশালা দিবস উপলক্ষে জেলার এমনই নানা পুতুল নিয়ে তিন দিনের এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ। জানা গেল নানা অজানা গল্প। নবদ্বীপের পুরাতত্ত্ব পরিষদের সভাগৃহে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন লোকশিল্প সংগ্রাহক বিধান বিশ্বাস। তিনি জানান, পুতুলের কয়েকটি শ্রেণি রয়েছে। একটা ভাগ হল দেবপুতুল। আর একটা ভাগ খেলনা পুতুল। এর বাইরে আর এক ধরনের শ্রেণিবিন্যাসও রয়েছে। হাতে গড়া পুতুল আর মাঠের পুতুল। বাংলার নানা রকম পুতুলের মধ্যে বিভিন্ন মেলার পুতুল, মানুষের পুতুল, পশুপাখির পুতুল, টেপাপুতুল, গালার পুতুল, টেরাকোটার পুতুল সবই হাজির এই প্রদর্শনীতে।
পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “পুতুল যে শুধু খেলার উপকরণ, তা নয়। তা দিয়ে যেমন ঘর সাজানো হয় তেমনই বহু সম্প্রদায় ধর্মাচরণের অঙ্গ হিসাবে পুতুল ব্যবহার করেন। মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছিল গয়লানি পুতুল, মাথায় উকুন বাছা পুতুল। হাতে তৈরি সরল নির্মাণ শৈলির কাজ। তার পর তাকে পুরিয়ে খড়ি দিয়ে সাদা রং। লাল দিয়ে চোখ মুখ। এসেছে বর্ধমানের নতুন গ্রামের মমি পুতুল। |
জোড়বিহীন এক কাঠের উপর পেঁচা, হাত তোলা গৌরাঙ্গ, বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া, বীরভূমের রাজনগরের পুতুল। গয়লানি পুতুল সামাজিক চিত্রকে তুলে ধরে, তেমনই রোগ-বালাই থেকে বাঁচার জন্যও রয়েছে পুতুল। মাথায় উকুন বাছা পুতুল তারই দৃষ্টান্ত।
আগে কাঠ, মাটি এবং শোলা দিয়ে পুতুল তৈরি হত। পরবর্তী কালে পিতল, পাথর, তালপাতা, পাট, কাপড়, বাঁশ-বেত, প্লাস্টার অফ প্যারিস হয়ে এখন তো সিন্থেটিক এর যুগ। আগে ভুসো কালি, গিরিমাটি, হরিতকি প্রভৃতি প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার হত। তার পর এল রাসায়নিক রং।
হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল সভ্যতার প্রাচীনতম পুতুল। মুগ্ধ হয়েছিল পৃথিবী। ঘূর্ণির সুবীর পালের তৈরি মাটির পুতুলের বাগান দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন মিশেল ওবামা। কিন্তু শুধু মুগ্ধতায় পেট ভরছে না পুতুল শিল্পীদের। পুতুলের বাজার নিয়ে বলতে গিয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়ে শিল্পী গোপাল বিশ্বাসের। বলেন, “ঘর সাজানোর জন্য অনেকে পুতুল কিনছেন। কিন্তু যাদের জন্য পুতুল, সেই ছোটরা আর ফিরেও চায় না।”
তাই মণ্ডপের উপাদানে ও গৃহসজ্জায় পুতুলের বাণিজ্যিক ব্যবহারের চেষ্টা আর কত দিন পুতুল শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখে প্রশ্ন সেটাই।
|