অ্যালেক্স ফার্গুসনের বিদায়ী ম্যাচে প্রচলিত প্রথা ভেঙে তাঁর হাতে লিগ কাপ তুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ফুটবলাররা!
ম্যাচের আগে ‘স্যর’-কে গার্ড অফ অনার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বী দু’দল ম্যান ইউ এবং সোয়ানসির তরফ থেকে।
কিন্তু ইস্টবেঙ্গল কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হলে বিদায়ী কোচ ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের হাতে কোনও স্মারক তুলে দেওয়ার আর্জি মেহতাব-চিডিরা জানাননি। ক্লাব সূত্রের খবর, প্রবল ইচ্ছে থাকলেও ক্লাবে মর্গ্যান-বিরোধীদের কোপে পড়ার ভয়ে সে পথ মাড়াননি লাল-হলুদের কোনও ফুটবলার।
আর মর্গ্যান স্যরকে দু’দলের ‘গার্ড অফ অনার’? ডার্বিতে প্রতিপক্ষ দলের কোচ করিম বেঞ্চারিফা তো বুধবার তাঁর মিনিট কুড়ির সাংবাদিক সম্মেলনে এক বার নামও নিলেন না মর্গ্যানের। উলটে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল ইঙ্গিতপূর্ণ কটাক্ষ, “এই ম্যাচে স্ট্র্যাটেজি পরে আসবে। জিতবে সেই দলই, যার কলজের জোর আছে।”
ওল্ড ট্র্যাফোর্ড কলকাতার ক্লাবগুলোকে শিক্ষা দেবে না জানাই ছিল। কিন্তু মর্গ্যানের বিদায়-মঞ্চ মোহনবাগানের মরক্কান কোচকে ছোঁবেই না, ভাবা যায়নি! সম্ভবত সে জন্যই ছত্রিশ মাস কাটিয়ে ইস্টবেঙ্গলে তাঁর শেষ অনুশীলনের আগে এবং পরে সাহেব কোচকে লাগল একেবারেই অচেনা। গম্ভীর, বিব্রত, আবেগপ্রবণ, নস্ট্যালজিক। প্রায় সকলের শেষে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার মুখে এক দল লাল-হলুদ সমর্থক নিজেদের পকেটের কড়ি খরচা করে ব্রিটিশ কোচের হাতে তুলে দিলেন বাংলার দুই সেরা ব্র্যান্ড — পাঞ্জাবি এবং রসগোল্লা। সঙ্গে শুভেচ্ছার ফুল। মর্গ্যানের চোখের কোণে মনে হল, দু’-একফোঁটা জল টলটল করছে। কিন্তু ওইটুকুই। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের তা হল, এ রকম একটা দিনে ক্লাবের কোনও বড় কর্তাকেই দেখা যায়নি তাঁবুর আশেপাশে! (কর্তারা অবশ্য দাবি করছেন, কোচ তো এখনও শেষ কথা বলেননি।) দীর্ঘদেহী ব্রিটিশ ভদ্রলোক যখন তাঁর শেষ অনুশীলন করিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসছেন, তখন তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, জাহাজ থেকে হঠাৎই ব্রাত্য হয়ে যাওয়া কোনও নাবিক! |
আজ, বৃহস্পতিবার কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তীব্র উত্তেজক ডার্বিতে এই ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’-ই কি মর্গ্যানের টিমের মোটিভেশন?
মেহতাব হোসেন থেকে চিডি, ওপারা থেকে ইসফাক ‘র্যান্ডম স্যাম্পল’ সমীক্ষা করুন, দেখবেন অন্তত আশি শতাংশ লাল-হলুদ ফুটবলারের গলায় বাজছে একটাই সিডি কোচের জন্য জিততে চাই....। “আমার দেখা সেরা কোচ। ওঁর শেষ ম্যাচে কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সবাই করলে করতাম। হয়নি যখন, কাল চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে সেটাই হবে তাঁকে সম্মান জানানোর সেরা রাস্তা,” বলছিলেন মরসুমের শেষ ডার্বির ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক মেহতাব।
বুধবার সকালের তীব্র দাবদাহের মধ্যে অনুশীলনে অন্য দিনের মতোই মর্গ্যান খেলছিলেন ফুটবলারদের সঙ্গে। মর্গ্যান ‘সফল’ হলেই একযোগে হাততালি দিয়ে উঠছিলেন নওবা-পেন-লালরিন্দিকারা। ব্যাপারটা প্রতীকী হতে পারে, কিন্তু পেশাদার মর্গ্যানের কথা শুনে মনে হল, এই ‘হাততালি’-ই আজ সন্ধ্যায় শেষ ম্যাচে শুনতে চাইছেন তিনি। বাঙালি কোচেদের মতো, ‘আমার জন্যই ট্রফিটা তোমাদের জিততে হবে’ মার্কা আবেগময় ভাষণ নয়, লাল-হলুদের কোচ হিসেবে শেষ ম্যাচ খেলতে নামার চব্বিশ ঘণ্টা আগে মর্গ্যান বলে দিয়েছেন, “গত তিন বছরে সাতটা ট্রফি পেয়েছি। প্রচুর ম্যাচ জিতেছি, আর একটা ম্যাচ। এটা জিততে পারলেই সব ঠিকঠাক শেষ হবে।” দলে সামান্য পরিবর্তন করছেন মর্গ্যান। বদলাচ্ছেন স্ট্র্যাটেজি। চিডিকে একমাত্র স্ট্রাইকার রেখে পিছনে পেন-লোবোকে রাখা হচ্ছে। ফর্মেশনটা ৪-৩-২-১। ওপারার সঙ্গে স্টপারে অর্ণব। ‘বিদ্রোহী’ সঞ্জু প্রধান থাকবেন রিজার্ভ বেঞ্চে। “আমরা ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু সেটা ভেবে মাঠে নামলেই ডুবতে হবে। মোহনবাগানকে জিততেই হবে। ওরা তাই অল আউট খেলবে। ম্যাচটা কিন্তু উপভোগ্য হবে,” বলছিলেন লাল-হলুদের বিদায়ী কোচ। ফুটবল মক্কার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে যাওয়ার আগে ঘুরিয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে সম্মুখ সমরে আসার আহ্বান, মনে হচ্ছিল।
অবনমন বাঁচানোর গর্বে ‘গর্বিত’ করিম কি সেই আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন? “এটা আমাদের কাছে ডু অর ডাই ম্যাচ। সব ডার্বি-ই স্পেশ্যাল। কিন্তু এই ডার্বিটার গুরুত্ব অন্য জায়গায়। জিতলেই চ্যাম্পিয়ন। আর এটাই মরসুমের শেষ ম্যাচ। জিতলে আমাদের আনন্দ সবাই আনন্দ নিয়ে বাড়ি যেতে পারবে।” করিমের কথাবার্তায় পরিষ্কার, মর্গ্যানের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধে জেতার জন্য মানসিক ভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছেন। কার্ডের জন্য মাঝমাঠে ধারাবাহিক ভাল খেলা কুইন্টন নেই। ইচে-ডেনসনের চোট। তবুও দু’জনকেই খেলাতে হচ্ছে। তবে চোটের জন্য স্নেহাশিস চক্রবর্তীর খেলা অনিশ্চিত। এই অবস্থার মধ্যেও মোহন-কোচের গলায় টংকার, “ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্স ভাল। কিন্তু আমাদের ফরোয়ার্ড লাইনও যথেষ্ট শক্তিশালী। ওডাফার ছ’ছটা হ্যাটট্রিক আছে এ বছরই।” কিন্তু মরসুমে তিনটে ডার্বি হয়ে গেল, ওডাফার তো গোলই নেই? “কাল করবে।’’ নিশ্চিন্ত শোনায় মোহন-কোচের গলা।
আঠারো জনের নিউক্লিয়াস টিম বেছে বাকি প্লেয়ারদের করিম বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন গত মঙ্গলবারই। কর্তারা বকেয়া মাইনের একটা অংশ মিটিয়েছেন ফুটবলারদের ‘মস্তিষ্ক’ ঠান্ডা রাখতে। কলকাতা লিগ জেতার আশায় হাপিত্যেশ করে থাকা অসংখ্য সবুজ-মেরুন সমর্থকের মধ্যে এ দিন অনুশীলনে হাজির শ’দুয়েকের জয়ধ্বনিতে বাগানের দমবন্ধ আবহাওয়া কিছুটা পালটেছে হয়তো। করিমও তাই আশাবাদী। না হলে কেন বলে বসবেন, “আই লিগের অবনমনের চাপ থেকে বেরিয়ে আসাটা অনেক কঠিন, ডার্বি লড়াইয়ের চেয়েও।”
মর্গ্যান বনাম করিম ‘মহাযুদ্ধে’ ট্যাকটিক্সের ঝনঝনানি থাকবেই। থাকবে চাল ও পালটা চালের মগজাস্ত্র প্রয়োগের সব উপকরণ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মরসুম শেষের ডার্বি-সূর্য ঢলবে কোন দিকে? বেঙ্গলে না বাগানে! ফার্গুসনের ঢঙে হাত নাড়তে নাড়তে মর্গ্যান বিদায় নিতে পারবেন কি না, জানা যাবে আজ সন্ধ্যায় ম্যাচ শেষে। তবে এটা নিশ্চিত, করিম তাঁর মেরুন শার্ট পরে বৃহস্পতিবার রিজার্ভ বেঞ্চে কিছুতেই বসবেন না। “সবাই বলছে ওটা অপয়া!” হাসতে হাসতে বললেন মর্গ্যানের প্রতিদ্বন্দ্বী কোচ।
|
ডার্বিনামা |
কার কপালে কী |
মোহনবাগান: দু’মরসুম পরে কলকাতা লিগ জেতার সুযোগ। তিন বছরের ট্রফি-খরার শাপমুক্তি
(এ বার এয়ারলাইন্স কাপে চ্যাম্পিয়ন হলেও ফাইনালে ওয়াকওভার পায়)।
ইস্টবেঙ্গল: কলকাতা লিগ জয়ের হ্যাটট্রিকের সুযোগ। ফেডারেশন কাপের পরে মরসুমের দ্বিতীয় ট্রফি।
করিম বেঞ্চারিফা: করিমের হাত ধরে ফের ট্রফির হাতছানি বাগানে। ২০০৯-এ মরক্কান কোচের গড়া
ভিতে
লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মোহনবাগান। ট্রফি তোলার সময় কোচ ছিলেন বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য।
ট্রেভর মর্গ্যান: ইস্টবেঙ্গলের হয়ে বিদায়ী ম্যাচে ট্রফি জেতার সুযোগ।
জিততে পারলে ৩ বছরে ৮টি ট্রফি দেবেন লাল-হলুদকে
। |
সংগঠন ও নিরাপত্তা |
• স্টেডিয়ামে ১৬০০ পুলিশ ও ৩০০ বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী। মাঠে ঢুকতে ত্রিস্তর পরীক্ষা।
• যুবভারতীর ছ’টা গেটেই সিসিটিভি।
• ৫০টা করে কার্ড দেওয়া হয়েছে দুই ক্লাবকে। এই কার্ড
ছাড়া ড্রেসিংরুমের আশেপাশে যাওয়া যাবে না।
• ফ্লাডলাইট সারাক্ষণ জ্বলবে জেনারেটরে।
• স্টেডিয়ামের ভিতরে খাবার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা।
• বরাবরের নিষিদ্ধ সরঞ্জামের সঙ্গে এ বার জলের বোতল, ছাতা ও খবরের কাগজ নিয়েও মাঠে ঢোকা নিষেধ।
|
যে সব প্রস্তাব খারিজ |
• গ্যালারিতেও সিসিটিভি।
• ভিআইপি গ্যালারিতে সিট নম্বর।
• দুই ক্লাবের সদস্যদের জন্যও কমপ্লিমেন্টরি টিকিটের ব্যবস্থা। |
আজকের ডার্বির
সবচেয়ে পোড়খাওয়ারা |
• মেহতাব হোসেন: ৪১ ম্যাচ, ২ গোল
(ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ১, মোহনবাগানের
হয়ে ১)
• দীপেন্দু বিশ্বাস: ৪০ ম্যাচ, ৬ গোল (ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ৪, মোহনবাগানের
হয়ে ২)
• রহিম নবি: ৩২ ম্যাচ, ৪ গোল
(সব ইস্টবেঙ্গলের হয়ে)
• সৌমিক দে: ৩২ ম্যাচ, ১ গোল
(ইস্টবেঙ্গলের হয়ে) |
তথ্য হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় |
|
বৃহস্পতিবার কলকাতা লিগে
ইস্টবেঙ্গল: মোহনবাগান
(যুবভারতী ৫-০০)। |