পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভার ধরে গেলে মিনিট পঁচিশের দূরত্বে দুটো জায়গা।
শহর এক, দুটো জায়গার মধ্যে পারস্পরিক একটা সম্পর্কও আছে, একই উপলক্ষ ঘিরে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আজ দু’জায়গাকেই কেমন যেন অচেনা লাগছে।
বাইপাসের ধারের টিম হোটেলে সচিন তেন্ডুলকর ঢুকছেন। ক্যামেরার দু’একটা ফ্ল্যাশ জ্বলল, কিন্তু উৎসুক আট থেকে আশির মুখ? নাহ, নেই। |
আজ বাদে কাল কলকাতায় আবার ক্রিকেট উৎসব। আসছে শুক্রবার প্লে-অফ, রবিবার আবার আইপিএল ফাইনাল। এত বড় ক্রিকেট-যজ্ঞ সাম্প্রতিক অতীতে দেখেনি কলকাতা। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি বলে, টিকিট নিয়ে অনন্ত চাপ থাকলেও সিএবি কর্তাদের মেজাজ এই সময় ফুরফুরে থাকে। কিন্তু কোথায় কী?
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের দরজা বন্ধ। বোর্ডের দুর্নীতিদমন বিভাগের কর্তারা আসছেন-যাচ্ছেন। নিয়মের কাঁটাতারে বেঁধে ফেলা হচ্ছে কলকাতার আইপিএল যজ্ঞকে। নিত্যনতুন সব বিধিনিষেধ, ডু’জ-এর চেয়ে ডোন্ট’স বেশি।
প্লে-অফ জেতো, চ্যাম্পিয়ন হও, কিন্তু যাবতীয় উৎসব-নাচানাচি সব মাঠেই শেষ করে এসো। রাতের পার্টি-ফার্টি সব বন্ধ।
হোটেলের ঘরে একমাত্র স্ত্রীর ‘এন্ট্রি পারমিট’ আছে। বান্ধবী হোক বা অন্য কেউ, ক্রিকেটাররা কাউকেই ঘরে আনতে পারবেন না।
ইচ্ছেমতো হোটেলের বাইরে যাওয়া আর চলবে না। বেরোতে হলে নিরাপত্তার আধিকারিকদের সবিস্তারে ‘কেন, কোথায়, কখন’ জানিয়ে যেতে হবে। |
ড্রেসিংরুমে এক বার ঢুকে পড়লে মাঝপথে হোটেল বা ইডেনের কোনও বক্সে যাওয়া যাবে না।
সচিন যখন সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ টিম হোটেলে ঢুকছেন, তখন সিএবি কর্তাদের নির্দেশনামা ধরিয়ে গেলেন দুই বোর্ড প্রতিনিধি। আজ, বৃহস্পতিবার শহরে চলে আসছেন বোর্ডের দুর্নীতিদমন বিভাগের চার আধিকারিক। দু’জন থাকবেন দুটো টিমের সঙ্গে। বাকি দুই ইডেনের গ্যালারিতে। আসতে পারেন বিভাগীয় প্রধান রবি সওয়ানি-ও।
কলকাতা পুলিশের সঙ্গে একপ্রস্ত কথা ইতিমধ্যেই হয়েছে। এবং স্পট-ফিক্সিংয়ের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে ক্লাবহাউসের লোয়ার টিয়ারকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, ইডেনের বাইশ গজের একদম মুখোমুখি হওয়ায় লোয়ার টিয়ারে বসে মাঠে থাকা ক্রিকেটারদের সঙ্গে ফিক্সিং সংক্রান্ত সিগন্যাল আদানপ্রদান করা সহজ হতে পারে। তাই সিসিটিভি-র আধিক্য যেমন লোয়ার টিয়ারে থাকছে, তেমনই সাদা পোশাকের আইবি-র (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) লোকজনও ঘোরাফেরা করবেন।
টিম হোটেলেও নিরাপত্তা রাতারাতি বেড়ে গিয়েছে। আর পাঁচটা আইপিএল ম্যাচের সময় যে রকম নিরাপত্তা থাকে, তা তো আছেই। সঙ্গে এ বার বজ্র আঁটুনি। জন্টি রোডস, জন রাইট-রা কফিশপে নিরামিষ আড্ডাতে বসলেও কয়েক জোড়া চোখ সমানে নজর রাখছে। সিকিউরিটি এজেন্সির প্রতিনিধিদের সঙ্গে হোটেলে থাকছেন পুলিশের পদস্থ কর্তারাও। |
সব দেখলে মনে হবে আইপিএল ম্যাচ আর কোথায়? এ তো ক্রিকেটকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া খলনায়কদের বিরুদ্ধে বোর্ডের জীবনযুদ্ধের ‘ম্যাচ’। দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়ে খেলাটার প্রতি সম্মান ফেরানোর ম্যাচ।
ভাবলে এতটুকু ভুল হবে না। আগামী শুক্র ও রবি, ক্রিকেটের দুই মহাযজ্ঞ আছে। নিজ মেজাজে স্বয়ং ক্রিকেট-ঈশ্বর আছেন। সেই চেনা হাসিমুখ, ভক্তদের দিকে হাত নাড়া সব আছে। কাঠামোয় তো কোনও খুঁত নেই।
কিন্তু হৃদয়? আশ্চর্য হলেও সত্যি এই প্রথম শহরে সচিনের আগমন ব্যাকফুটে, মুখ্য স্পট-ফিক্সিং প্রতিরোধের প্রাণান্তকর চেষ্টা। জুয়াড়িদের কলঙ্কের বাজারে ‘তেন্ডুলকর’ শব্দের সম্মোহনও যেন আজ বিপন্ন!
|