|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
কে ঠেকাবে ‘আমরা’র দাপট? |
যে ক্ষমতাবান সে ‘আমরা’, আর ক্ষমতার
বাইরে থাকারা ‘ওরা’।
এই অসুখ বিশ্বজনীন।
বাঙালিরও এটা পুরনো অসুখ। |
চিন্ময় গুহ |
বেশ কয়েক বছর হল (না কি কয়েক দশক) বাঙালির একটি খারাপ অসুখ করেছে। অসুখটার নাম ‘আমরা-ওরা’। একের পর এক ‘আমরা-ওরা’র মিছিল, আমরা দেখেছি, দেখেই চলেছি। যখন শিক্ষাজগতের কদর্য তলপেট সকলের কাছে উন্মোচিত হয়ে গেছে, আমরা জেনে গেছি ‘আমরা-ওরা’-ই সমস্ত অনর্থের মূল, তখন পণ্ডিতেরা আকাশে রাজপ্রাসাদ গড়া নিয়ে কূটকচাল করলে বেশ কৌতুক হয়। আজ যখন সমাজের সর্বাঙ্গ আক্রান্ত, পচনের দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, তখনও চোখে ঠুলি পরে থাকলে আখেরে সমাজের মঙ্গল হবে না।
বর্তমান অসুখটা যে প্রকট ভাবে রাজনৈতিক, সেটা আমরা সকলেই জানি। এবং এর উদ্বোধন যে অন্তত দু’-তিন দশক আগে, তাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু এই অসুখটির উৎস যে বহু আগে থেকেই বাঙালি মানসিকতার ইতিহাসের মধ্যে নিহিত, তা অস্বীকার করবে কে?
‘অন্য’ (other) নামক প্রকল্পটি ঔপনিবেশিকতার পদ্ধতি-প্রকরণের সঙ্গে জড়িত একটি কূট রাজনৈতিক প্রকল্প। ক্ষমতাভোগী ও ক্ষমতাহীন, ধনী-দরিদ্র, প্রথম বিশ্ব-তৃতীয় বিশ্ব, সাদা চামড়া-কালো চামড়া নিয়ে ‘আমরা-ওরা’-র সংঘাত বিশ্বজনীন সমস্যা। কাজেই বাঙালির যে এই সংক্রামক অসুখগুলো থাকবে। সেটা বলা বাহুল্য, মায় ফরসা-কালোর অসুখটি। |
|
বাংলা কাগজে পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের মতো নির্মম সমাজদর্পণ আর একটিও নেই। সেগুলি পড়লে এক শ্রেণির উন্নাসিক মধ্যবিত্ত বাঙালির অহঙ্কার চুপসে যাবে। বর্ণবৈষম্য, জাতপাত, বাঙাল-ঘটি, গ্রাম-শহর, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে ‘শিক্ষা’-র দম্ভ এবং টাকার গরম কিছুই সেখানে লুকোনো নয়।
কিছু দিন আগে এক ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ জানালেন, কয়েকজন দরিদ্র বস্তিবাসীকে কলকাতার এক ‘শিক্ষিত’, ‘উদার’ পরিবারে নিয়ে আসায় তাঁরা আর্তনাদ করে ওঠেন: ‘ছি ছি! ওরা খুব নোংরা!’ অন্নদাশঙ্কর রায় আমায় বলেছিলেন, যে দিন এক বিখ্যাত কমিউনিস্ট কবি পঞ্চাশের দশকে মুখ ফসকে ‘ওরা’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তিনি বুঝেছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের দফা সারা হয়ে গেছে।
সুতরাং, প্রতি পদক্ষেপে শ্রেণি-বিভাজন আমাদের জাতিগত ঐতিহ্য। শোষক-শোষিতের মার্ক্সীয় ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আমাদের অতি নিজস্ব ধরনের বাঙালি ‘অপরায়ণ’, যাতে বাঙালির সবচেয়ে কুখ্যাত মানসিক ব্যাধিটিও সেখানে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে, ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা। গুপী গাইনকে গ্রাম থেকে তাড়ানো গাছতলার পরশ্রীকাতর মোড়লেরা যে-কোনও মুহূর্তে ‘আমাদের লোক’কে পরিত্যাগ করতে পারে, যদি তার কোনও বিশেষ গুণাবলি থেকে থাকে, যার পাশে নিজেদের হীনম্মন্যতা বোধ হবে।
‘তবে রে পাজি লক্ষ্মীছাড়া
আমার পরেই বিদ্যেঝাড়া
পাত্রাপাত্র নাই কি রে হুঁশ
দে দমাদম ধাপুস ধুপুস।’
হুতোমও লিখেছেন: ‘আমাদের বিপদে মুচকি হাসেন ও আমোদ করেন, তাঁদের এক চোক্ কানা হয়ে গেলে যদি আমাদের দুচক্ষু কানা হয়, তাতে এক চক্ষু দিতে বিলক্ষণ প্রস্তুত—’ ‘শত্তুররা খাওয়াদাওয়া ও শোয়ার সঙ্গে আমাদের নিন্দে করা সংকল্প করেছিলেন। সুতরাং কিছুতেই থামলেন না।...বিনা দোষে নিন্দা করাও সহরের কতকগুলি লোকের কর্ত্তব্য কর্ম্ম ও ব্রতের মধ্যে গণ্য—’।
কাজেই নানা চোরা স্রোত আমাদের সমাজজীবনকে ভেতর থেকে ছোবল মেরে চলেছে। আর আমরা অহোরাত্র বিষ পান করেছি সম্ভবত এই আশায় যে, যদি ঘোলা জলে দু’চারটে মাছ ধরা যায় ক্ষতি কী? বিশ্বায়ন যখন হুড়মুড় করে বাঙালি পল্লিসমাজে
এসে আছড়ে পড়ল, অসুখগুলি আরও স্পষ্ট হল।
কিন্তু এই সব দৈনন্দিন ক্লিন্নতার পর এল আলোচ্য কালব্যাধিটি। যে ক্ষমতাবান সে ‘আমরা’, যারা ক্ষমতার করিডোরের বাইরে তারা ‘ওরা’। ‘আমরা’-র দাপট ঠেকায় কে? গতকালের ‘আমরা’-রা আজকের ‘ওরা’, গতকালের ‘ওরা’-রা আজকের আমরা’! এ যেন কিন্ডারগার্টেনের শিশুদের খেলা। হুতোমের ভাষায়, ‘খেঁউড় ও পচালের স্রোত বইতে লাগ্লো...দুই দলে কৃতাস্ত্র ও সেনা সংগ্রহ করে সমরসাগরে অবতীর্ণ হলেন,— ইস্কুলেরা বয়েরা ভূরি ভূরি নির্ব্বুদ্ধি দলবল সংগ্রহ করে কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধ ঘটনার ন্যায় ভিন্ন ভিন্ন দলে মিলিত হলেন— দুর্ব্বুদ্ধিপরায়ণ ক্যারানী, কুটেল ও বাজে লোকেরা সেই কদর্য রস পান করবার জন্য কাক, কবন্ধ ও শৃগাল শকুনির মত রণস্থল জুড়ে রইলো।’
শিক্ষাজগতের তলপেটের সঙ্গে সাম্প্রতিক পরিচয়ের সময় বুঝেছি আসল সমস্যা এটাই। প্রতিভাবান ও গুণীদের যাচাই করার আগে দু’পক্ষকেই জানতে হবে ‘আমাদের লোক’ কি না। অযোগ্য হলেও অসুবিধে নেই, যদি ‘আমাদের’ হয়। তখন সুকুমার রায়ের আদুরে পুতুলের মতো দু’পক্ষ গেয়ে উঠবে: ‘যাদুরে আমার আদুরে গোপাল, নাকটি নাদুস থোপ্না গাল— ঝিকিমিকি চোখ মিটিমিটি চায়, ঠোঁট দুটো লাল।’
তার পর শুরু হবে ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’-র নারান আর কেদারের গান:
‘হেঁসে খেলে নেওরে যাদু মনের সুখে।
কে কবে, যাবে শিঙ্গে ফুঁকে’
‘ক’-এর প্রশংসা করলে আপনি ‘ক’-র পক্ষে, অর্থাৎ ‘খ’-র বিরুদ্ধে। আর ‘ক’-র সমালোচনা করলে আপনি ‘খ’-র লোক, এমন ভাবার মধ্যে যে একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক অপ্রাপ্তমনস্ক নির্বুদ্ধিতা ও মনোবৈকল্যের ব্যাপার আছে, সেটা বোঝার সময় এসেছে।
বোঝার সময় এসেছে যে উনিশ শতকের ভিন্ন স্রোতের এত দিন পর এ সব ছেলেমানুষি মানায় না।
বোঝার সময় এসেছে যে আমাদের দু’টি চোখ, একটি নয়। |
|
|
|
|
|