|
|
|
|
কথোপকথন... |
‘এখন আমরা ঘরে ঘরে যাচ্ছি, কাজ চলছে’ |
আন্দোলন থেমে নেই। ‘বৃহত্তর মানুষকে জুড়তে হবে শাহবাগের সঙ্গে এবং
সেই জন্যই আমরা দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু করেছি।’ কয়েক দিন আগে ঢাকায় এক
একান্ত
কথোপকথনে জানালেন শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ ইমরান সরকার |
জয়ন্ত বসু |
রাত্রি ন’টা। শাহবাগ স্কোয়ার। পুরনো ঢাকা থেকে নব্য শহরের দিকে আসা অজস্র গাড়ি আর সাইকেল রিকশায় জমজমাট। মাঝে মাঝে ভিড় একটু পাতলা হলে চোখে পড়ছে, রাস্তার প্রস্থ জুড়ে সাদা রং দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা: গণজাগরণ মঞ্চ। রং কোথাও কোথাও সামান্য ফিকে হয়ে গিয়েছে। এই সেই চত্বর, যেখানে কিছু দিন আগেও লক্ষাধিক মানুষ বহু দিন ও রাত কাটিয়েছেন, তাঁদের আন্দোলন গোটা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছে। আজ কোথায় সেই আন্দোলনের গতিপথ? নির্বাচনমুখী বাংলাদেশের নানান টিভি চ্যানেলের রাজনৈতিক বিতর্কে শাহবাগ এখন আর খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে না। তবে কি রাস্তাজোড়া বর্ণমালার সাদা রঙের মতোই আন্দোলনও ফিকে হয়ে গেল? না কি, সে আপাতত আগামী বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে?
শাহবাগ আন্দোলন সর্বার্থেই নাগরিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্রছাত্রীদের হাত ধরে উঠে আসা। বাংলাদেশের গ্রামের মানুষদের কাছে শাহবাগ আন্দোলন তেমন কোনও বড় বিষয় নয়। শহরের গরিব মানুষও যে এর সঙ্গে খুব বেশি একাত্ম হয়েছিলেন, এমন নয়।
কিন্তু এটা যদি আন্দোলনের ব্যর্থতা হয়, তবে এক অর্থে এটাই তার সাফল্যের চাবিকাঠি। ৫ ফেব্রুয়ারি হাতে গোনা ‘দশ থেকে বিশ জন’ নিয়ে যে আন্দোলনের শুরু, কেমন করে কয়েক ঘণ্টায় হাজার, কয়েক দিনে হাজার পেরিয়ে লাখে পৌঁছল, তা ইতিহাস। এবং তারা কারা? যারা বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম, ভবিষ্যতের কারিগর। মনে পড়ছে বাংলাদেশের রেডিয়ো সাংবাদিক নুসরতের কথা, “শাহবাগ ব্যর্থ না সফল, তা সময়ই বলবে। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি যে, আমাদের প্রত্যেকের মনে একটা করে শাহবাগ তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজন হলেই আবার সেই লুকোনো শাহবাগ বেরিয়ে আসবে।”
সত্যিই কি তা-ই? উত্তর খুঁজতে গত ১৬ মে হাজির হলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনতলায় ক্যান্টিনের পাশে দশ বাই আট ঘরে জনা বারো ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে বসে থাকা ইমরান সরকারের মুখোমুখি। ইমরান শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ। |
|
আন্দোলনের শরিক। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ছবি: এ এফ পি। |
শাহবাগ আন্দোলন এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?
আন্দোলন এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে। আমরা আন্দোলনের গোড়ার দিকে প্রায় কুড়ি দিন ও রাত একটানা শাহবাগে জমায়েত করেছিলাম। সে একটা অদ্ভুত অবস্থা। হাজারে হাজারে স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ রাস্তায় বসে আছে। কী খাবে, কোথায় থাকবে, কোনও চিন্তা নেই। শুধুমাত্র দাবিপূরণ চাই। কিন্তু এমন করে তো বেশি দিন চলতে পারে না। অনেকে বাইরে থেকে চাকরি ছেড়ে, দোকান ফেলে এসেছেন। জানেন না চাকরি রইল কি না, দোকান কী অবস্থায়। আমরা সারা দিন ও রাতের বদলে আন্দোলনকে তিনটে থেকে দশটা অবধি নির্দিষ্ট করলাম। তার পর অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে মানুষকে সাত দিনের একটা সীমা ধার্য করে ফেরত পাঠানো হল। জমায়েত প্রত্যাহৃত হল। ইতিমধ্যেই সরকারও বেশ কিছু দাবি মেনে নিয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী সংক্রান্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিষয়ক ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের আইনি পরিবর্তন। দেখবেন, আন্দোলন-পরবর্তী যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে যে রায়গুলি হয়েছে, যেমন কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়, সেগুলি অনেক সুসংহত ও যথাযথ।
আর একটা ব্যাপার ছিল। শাহবাগ আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ রূপে অহিংস। এত দিনের আন্দোলনে একটা মানুষকেও কেউ ধাক্কা দেয়নি, বা গাড়িতে ইট মারেনি। কিন্তু এটা নিশ্চিত রাখার জন্য আমাদের মতো মূল সংগঠকদের সারা ক্ষণ নজর রাখতে হত, সেটা করতে গেলে আগামী আন্দোলনের রূপরেখা বানানো সম্ভব হত না, যেটা আমরা এখন করছি। বহু দিন ধরে রাস্তা বন্ধ করার অভিযোগ উঠুক, এটাও আমরা চাইনি। এখন আমরা শাহবাগ আন্দোলনকে গোটা দেশের তৃণমূলে ছড়াতে চাইছি, বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক বিভাগীয় কর্মসূচি নিচ্ছি। আসলে যে কোনও আন্দোলনের একটা বিরতি দরকার হয়। দেখবেন, বঙ্গবন্ধুও এক সময় প্রত্যক্ষ আন্দোলন থেকে সরে এসে চাকরি করেছেন।
আপনাদের তো চট্টগ্রাম থেকে পিছু হঠতে হয়েছে। শাহবাগ-বিরোধী আন্দোলনও বড় আকার নিয়েছে...
হ্যাঁ, ঠিকই। চট্টগ্রামে আমাদের সমাবেশ বানচাল করার জন্য চক্রান্ত হয়েছে, ধ্বংসাত্মক আন্দোলন হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি হল। তা সত্ত্বেও আমরা বেশ কিছু দূর
|
ইমরান সরকার।
ছবি: শুভ্রা প্রিয়দর্শিনী |
গিয়েও ফিরে আসলাম। কেন না, আমরা ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মধ্যে ঢুকতে চাইনি। এতে উৎসাহিত হয়ে আরও ধ্বংসাত্মক আন্দোলন হল। আমরা অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশ করতে পারলাম না। কিন্তু গত ৩ তারিখ আমাদের কেন্দ্রীয় সমাবেশ হয়েছে। সারা দেশ থেকে প্রায় ৩৫০ গণজাগরণ মঞ্চ যোগ দিয়েছিল। যোগাযোগ বেড়েছে, প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। একটি কেন্দ্রীয় দল গাজিপুর, জামালপুর, শেখপুরের মতো অঞ্চলে গিয়েছে, ওখানকার সংগঠন ও মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। শহরাঞ্চলে বিভিন্ন অপপ্রচারের জবাব সোশাল মিডিয়া বা গণমাধ্যম দিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে তো ঘরে ঘরে অপপ্রচার চলছে...
গোড়া থেকেই কি আপনাদের মনে হয়নি যে শুধু সোশাল মিডিয়া বা গণমাধ্যম কেন্দ্রিক আন্দোলন সম্পূর্ণ সফল হতে পারে না?
ওটা ছিল প্রথম পর্ব। গোড়ায় আমাদের ক্ষমতা সীমিত ছিল। ব্লগ বা ফেসবুকের মতো সোশাল মিডিয়ার সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। মনে রাখবেন যে, শাহবাগের আগের তিন-চার বছর ধরে নানা বিষয় নিয়ে আমাদের সোশাল মিডিয়া-কেন্দ্রিক আন্দোলন চলেছে, সেগুলি বহু ক্ষেত্রে বেশ সাফল্যও পায়। রাস্তা বন্ধ হয়নি বা লাখ মানুষের জমায়েত হয়নি বলে আপনারা জানতে পারেননি! এটাও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ আমূল পালটে গিয়েছে। পাঁচ বছর আগে হাতে গোনা কয়েকটা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, এখন অজস্র। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে। ইন্টারনেট ব্যবহার ২০০৮ সালে কুড়ি লক্ষ থেকে এখন সাড়ে তিন কোটিতে দাঁড়িয়েছে। সোশাল মিডিয়া এখন অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, বৃহত্তর মানুষকে জুড়তে হবে শাহবাগের সঙ্গে এবং সেই জন্যই আমরা দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু করেছি।
অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লিগ সরকারের সঙ্গে অতি যোগাযোগই শাহবাগকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এক উচ্চপদস্থ বাংলাদেশি বন্ধু বলছিলেন, শাহবাগ তাঁকে গোড়ায় এত আলোড়িত করে যে তিনি কুড়ি বছর পর খাতা খুলে কবিতা লিখতে বসেন মধ্য রাতে। কিন্তু তাঁর কথা অনুযায়ী, যবে থেকে শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে আওয়ামী লিগ সরকারের যোগাযোগ স্পষ্ট হল তবে থেকেই তিনি সরে আসেন। প্রায় একই বক্তব্য, গুলশনের যে হোটেলে আমি ছিলাম তার কর্মীদেরও। কী বলবেন?
আমরা যখন ৫ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন শুরু করি, তখন এটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে, কোনও রাজনৈতিক দল তাদের ব্যানার নিয়ে আন্দোলনে আসতে পারবে না। ছাত্র সংগঠনরা পারবে। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে কেউ এলে আমরা আটকাতে পারি না। শুধু একটাই শর্ত, তার নিজস্ব দাবি যা-ই থাকুক, এখানে এসে তাকে আমাদের দাবির মধ্যে সীমিত থাকতে হবে। এই ভাবে অনেকে সঙ্গে এল, সরকারও বেশ কিছু পজিটিভ ভাবনাচিন্তা দেখাল, এবং এর ফলে একটা বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা হল যে আমরা সরকারকে, আওয়ামী লিগকে, সাহায্য করছি। কিন্তু আমরা আমাদের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দিইনি, সরকারকেও না। যখন তাদের ভূমিকা পছন্দ হয়েছে বলেছি, উলটোটাও। যেমন জামাতকে নিষিদ্ধ করার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার যে দাবি, সে বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া আশাব্যঞ্জক নয়, বলেছি। এ রকম আরও আছে।
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন? ভারতে সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের অনেকে মনে করেন, রাজনীতিতে না ঢুকলে রাজনীতির ময়লা সাফ করা সম্ভব নয়। আম আদমি পার্টি তৈরি হয়েছে...
(ঈষৎ থেমে থেকে) এটা একটা বড় বিতর্কের জায়গা। কেউ রাজনীতি করতে গিয়ে খারাপ কাজ করতে পারেন, কিন্তু রাজনীতি তো খারাপ নয়! আমি বা এরা কেউ (সঙ্গীদের দেখিয়ে) ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যোগ দেব কি না, তা কে জানে; তবে এটা বলতে পারি শাহবাগ আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও শেষ অবধি তাই থাকবে।
অনেকে বলছেন যে ধর্মীয় রাজনীতির সরাসরি বিরোধিতা শাহবাগের একটা বিরুদ্ধ শক্তি তৈরি করতে সাহায্য করেছে...
এটাও সুকৌশলে প্রচার করা হচ্ছে যে, আমরা যাবতীয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলেছি। এই ভাবে ইসলামিক দলাদলিকে উসকে দেওয়া হল। আমরা স্পিকারের কাছে যে দাবিপত্র দিয়েছিলাম, সেখানে শুধুমাত্র জামাতকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল। এটা ঘটনা যে, গোড়ার দিকে আমাদের মধ্যের কোনও কোনও সংগঠন থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল, কিন্তু সেটা কখনওই সরকারি ভাবে আমাদের দাবি নয়। যুদ্ধাপরাধীদের ঠিক বিচার ও শাস্তিই মুখ্য দাবি ছিল। এখানে অনেক মানুষ এসেছিলেন, বহু সামাজিক সংগঠন এসেছিল, আমরা তো তাদের স্লোগান দেওয়া বন্ধ করতে পারি না।
বিদেশে বহু মানুষ শাহবাগের সঙ্গে একমত হলেও ফাঁসির দাবির বিষয়ে একমত নয়, অ্যামনেস্টিও এ বিষয়ে বলছে...
আমরা তো আইনের বাইরে কিছু চাইছি না, এই বিধান তো আমাদের আইনেই আছে। অ্যামনেস্টির লোকজন এসেছিলেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওঁরা ফাঁসির বিষয়ে ওঁদের বক্তব্য জানিয়েছেন, কিন্তু সার্বিক ভাবে আন্দোলনের যৌক্তিকতা মেনেছেন।
শাহবাগ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী?
এই আন্দোলনকে ঠিক ভাবে ‘সাস্টেন’ করাটাই চ্যালেঞ্জ, তার জন্য একটা কাঠামো ঠিক করা প্রয়োজন। গোড়াতে আমরা ভাবতে পারিনি এমনটা হবে। একটা কল্পনা ছিল যে একটা ‘সেকুলার ফোর্স’ তৈরি হবে। কিন্তু আমার নিজস্ব মতামত যে আমরা সেটা খুব দ্রুত পেয়ে গিয়েছি; হয়তো সময়ের আগেই...
তাতে ভাল হয়েছে না খারাপ হয়েছে?
ভাল হয়েছে, আবার কিছু জায়গায় প্রচণ্ড চাপে পড়ে গিয়েছি। প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়েছে। মনে রাখতে হবে, একটা রাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন যে ভাবে দ্রুত গড়ে ওঠে, কাঠামো ঠিক না হলে তা আবার পড়ে যায়। ফলে আমরা এখন স্কুলে স্কুলে যাচ্ছি, বিভিন্ন জায়গায় বোঝাচ্ছি, যে কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই, মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষাকে সামনে আনছি। ভাবতে পারেন যে, অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা জানে না মুক্তিযুদ্ধ বা ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে ঠিক করে! কয়েকটা দাবি করলাম, দাবি পূরণ হল, আর আমরা ঘরে চলে গেলাম, এমন নয়। প্রশ্নটা আগামী বাংলাদেশ কেমন হবে, সেটা ঠিক করার, একটা ইডিয়োলজি নিয়ে লড়াইয়ের। আন্দোলনের বর্তমান অবস্থায় লাখ মানুষের জমায়েতের প্রয়োজন নেই, আর তা নেই বলে ক্রাইসিসও নেই। আমরা স্থির জানি যে, এক বার যাঁরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, প্রয়োজন হলেই তাঁদের নিশ্চিত পাওয়া যাবে। |
|
|
|
|
|