রাজি নয় আমেরিকার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে
বাস্তবের জমিতে থেকেই চিনকে মাপছে ভারত
চিনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং-এর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সাম্প্রতিক উষ্ণ করমর্দন দু’দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে এখনই কোনও আমূল পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছে না নয়াদিল্লি।
দু’দেশের কূটনীতি নিয়ে বলতে গিয়ে হিমালয়ের দুই প্রান্তের দুই দেশ একজোট হয়ে শক্তিশালী এশীয় ইঞ্জিন (এই ভাবেই ভারত-চিনকে বর্ণনা করে সারা বিশ্ব) গড়ে তোলার স্বপ্নকে সামনে রাখতে চাইছে চিন। আটটি বিষয়ে সমঝোতাও হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। কিন্তু মনমোহন-সলমন খুরশিদ অনেক দিন পর চিন সম্পর্কে একটা বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন।
‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’-এর রোম্যান্টিকতা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল ১৯৬২-র যুদ্ধে। নেহরুর কাছে তা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। সাউথ ব্লক বলছে, ২০১৩ আর ১৯৬২ এক নয়। কাজেই পরমাণু যুগে শত্রুতা মানেও যুদ্ধের ঝুঁকি নৈব নৈব চ।
চিনের সাম্প্রতিক কূটনীতিতে কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে একটা নতুন সম্প্রসারণবাদ দেখা যাচ্ছে। সেটি শুধু আর্থিক নয়, সামরিকও বটে। ইউপিএ জমানায় পাক অধিকৃত কাশ্মীরে চিনা সেনাবাহিনীর তৎপরতা দেখা গিয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকদের জন্য আলাদা করে স্টেপলড ভিসা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। এমনকী, চিন এখন দাবি করছে, দু’দেশের সীমান্ত দু’হাজার কিলোমিটার। যেখানে ভারতীয় সরকারি তথ্য বলছে, সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল, ভূটান, মায়ানমারের সীমান্তে চিন যে ভাবে সক্রিয়, তাতে বোঝা যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাহুবল প্রতিষ্ঠায় চিন সক্রিয়।
এই আচরণের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাউথ ব্লক মনে করছে, চিনেরও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাববোধ দেখা দিয়েছে। তিব্বত এবং জিয়ানজিয়াং এই দুটোই স্বশাসিত এলাকা, যাদের নিয়ে চিন বিব্রত। চিনের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়ও নয়াদিল্লিতে তিব্বতিদের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। জিয়ানজিয়াং-এ শতকরা চল্লিশ ভাগ মুসলমান। সেই এলাকায় জিহাদি তালিবানি শক্তি মাথাছাড়া দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চিন আগ্রাসী রণকৌশল নিচ্ছে আত্মরক্ষার তাগিদে।
জামশেদজি টাটার ছবির সামনে লি খ্যছিয়াং। পাশে সাইরাস মিস্ত্রি। ছবি: পিটিআই।
আকশাই চিনে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অনেকটাই ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
কারণ, ওই এলাকায় বেড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, কোনও খুঁটিও নেই। শীতকালে লাদাখ এলাকাটি বরফের মরুভূমি হয়ে যায়। এ হেন পরিস্থিতিতে ডিপসাং-এ চিনা সেনাদের প্রায় কুড়ি কিলোমিটার এগিয়ে আসাটা নিছক ভুল বলে মনে করছে না ভারত। সাউথ ব্লকের এক কর্তার ভাষায়, “ভুল করে সেনা ১-২ কিলোমিটার আসতে পারে। তাই বলে ২০ কিলোমিটার?” সাউথ ব্লকের কর্তারা আবার এ-ও মনে করছেন, চিনে যখনই কোনও নতুন নেতা দায়িত্বে এসেছেন (প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট যে-ই হোন না কেন), তখনই তাদের আস্ফালন শুরু হয়েছে। এটা প্রাথমিক ভাবে নিরাপত্তাহীনতা থেকেই হয় বলে তাঁদের বক্তব্য। চিনের পাল্টা অভিযোগ, তাদের জাতীয় সড়কের ধারে কার্যত তাদের ভূখণ্ডে ঢুকে ভারত নজরদারি ক্যামেরা বসিয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই, চিনা প্রধানমন্ত্রীর সফর এই পারস্পরিক দোষারোপ এবং ‘তু-তু-ম্যায়-ম্যায়’ পরিস্থিতিকে অনেকটা শান্ত করেছে।
ভারতের বক্তব্য, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ভারত এ বারে চিনকে তা জানিয়েছে।
প্রথমত, দু’দেশের মধ্যে সামরিক ভারসাম্যের অভাব তৈরি হয়েছে। সুতরাং দু’দেশের মধ্যে সামরিক আস্থাবর্ধক কর্মসূচি নিতে হবে। সীমান্ত বিবাদ মেটাতে দ্রুত কোনও সমঝোতা সূত্রে পৌঁছতে না পারলে এই উত্তেজনা বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, বেজিং চাইলেও আমেরিকা-জাপান-ভিয়েতনামের সঙ্গে ভারতের রণনৈতিক সম্পর্ক রাখতেই হবে।
তৃতীয়ত, চিন এশীয় ঐক্যের যুক্তিতে পশ্চিম বিরোধী জোট গঠন করতে আগ্রহী হলেও এবং ড্রাগন ও হাতির (চিন ও ভারত) ঐক্যের কথা মুখে বললেও তারা কি তাদের পাকিস্তান নীতি বদলাবে? তিব্বতের চিনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত তাদের অবস্থান পরিষ্কার করলেও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের প্রশ্নে চিন কি তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে?
চতুর্থত, অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অভাব। বাণিজ্য ঘাটতি চার হাজার কোটি ডলারের উপরে চলে গিয়েছে। এই ঘাটতি কমানোর আশ্বাস অবশ্য লি এ বারে দিয়েছেন। কিন্তু চিন তাদের বাজার খুলে দেওয়ার ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। এই দ্বিচারিতা নিয়ে মনমোহন কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন।
রোম্যান্টিকতার স্রোতে ভেসে না গিয়ে এ বার তাই সোজাসাপ্টা কথা বলেছেন মনমোহন-সলমন। বিদেশমন্ত্রী সলমন বলেন, “মতপার্থক্যকে রেড কার্পেটের আড়ালে লুকিয়ে সুসম্পর্কের চেষ্টা বৃথা। ভারতের বিদেশনীতি প্রাপ্তবয়স্ক। বন্ধুত্বের প্রধান শর্ত হল খোলামেলা আলোচনা।” আর তাই চিনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেই ২৭ তারিখে মনমোহন যাচ্ছেন জাপানে। আবার ইরানে গিয়ে ছাবাহার বন্দর গড়ার কথা বলছেন সলমন। আর আফগানিস্তানের সঙ্গে ইরানের সড়ক পথে যোগসূত্র তৈরি না করে এই বন্দর নির্মাণ সম্ভব নয়। নির্বাচনের মুখে হামিদ কারজাই ভারতে এসেছেন। কারজাইকে সরিয়ে সেখানে তালিবানি শক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। ভারত চিন-আফগানিস্তানের সম্পর্ককে পাকিস্তানের প্রিজমের বাইরে আনতে সচেষ্ট। ইন্ডিয়ান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারশেন রিসার্চ-এর অধিকর্তা রানি ডি মুলেনও বলেন, “চিন এবং আফগানিস্তান দু’পক্ষই পড়শি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে শান্তির আবহ তৈরি করার সুযোগ এনে দিয়েছে ভারতকে।”
দিল্লি এ-ও জানে, চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার পূর্বশর্ত কখনওই প্রবল মার্কিন বিরোধিতা নয়। সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকায় গিয়ে ওবামার সঙ্গে দ্বিতীয় বারের জন্য বৈঠক করে জোট নিরপেক্ষ বিদেশনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান মনমোহন। বহুমুখী, বহু রাষ্ট্রের পৃথিবীতে ভারত এগোতে চায় নতুন জোট নিরপেক্ষ কৌশলে।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.