|
|
|
|
|
|
পেপার গোল্ড
|
সোনা কিনলেই লকার খুঁজবেন না কি?
কাগুজে সোনা কিন্তু কাগুজে বাঘ নয়। বরং সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে
তার ভিত পোক্ত। গোল্ড-ইটিএফের জনপ্রিয়তার পারদ
তাই তরতরিয়ে ঊর্ধ্বমুখী।
জানাচ্ছেন সন্দীপ সিক্কা |
|
আজ থেকে ঠিক দশ দিন আগে পাড়ার সোনার দোকানগুলোয় ভিড়ের বহর দেখেছিলেন? খেয়াল করেছিলেন মিষ্টির প্যাকেট আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাস হাতে গয়না নেড়েচেড়ে দেখার ঠেলাঠেলি? আসলে অনেকেই বিশ্বাস করেন, অক্ষয় তৃতীয়ায় সোনা কিনলে, সৌভাগ্যও অক্ষয় হয়। সেই কারণেই ওই দিন সোনা কেনার অমন হুড়োহুড়ি।
অবশ্য সোনাকে বাদ দিয়ে কোন উত্সব, শুভ কাজই বা করি আমরা? বিয়ে হোক কি অন্নপ্রাশন, রথযাত্রা হোক কিংবা ধনতেরাস উপলক্ষ একটা পেলেই হল। সব সময়ই যেন সোনা কেনার অছিলা খুঁজি আমরা!
শুধু সাজে নয়, সঞ্চয়েও
তবে আজকাল সোনা আর শুধু সাজের অঙ্গ নয়। সঞ্চয়েরও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। আর হবে না-ই বা কেন? টাকা রাখার ঝুঁকিহীন, নির্ভরযোগ্য জায়গা হিসেবে বহু যুগ ধরে সোনার উপর আস্থা রেখে আসছে মানুষ। গত এক দশকে এই ধাতুর দামের দৌড়ও রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। এই সব কারণে গয়নার পাশাপাশি এখন সোনার বার কিংবা মুদ্রা (কয়েন) কেনার দিকে ঝুঁকছেন অনেকে। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কাগজে সোনাও। বিশেষত গোল্ড-ইটিএফ। আজ এখানে এই গোল্ড-ইটিএফ নিয়েই আলোচনা করব আমরা। দেখে নেব, নিখাদ সঞ্চয়ের জন্য কয়েন কিংবা বার কেনার তুলনায় গোল্ড-ইটিএফ কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ কি না?
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল। কাগুজে সোনা বা পেপার গোল্ডে বিনিয়োগ মানে কিন্তু শুধু গোল্ড-ইটিএফে টাকা রাখা নয়। হাতেনাতে না-কিনে কাগজের মাধ্যমে সোনায় টাকা ঢালা যায় মিউচুয়াল ফান্ডের গোল্ড ফান্ড এবং কমোডিটি এক্সচেঞ্জে (আগাম পণ্য লেনদেনের বাজার) কেনা-বেচার মাধ্যমেও। কিন্তু এই লেখায় বোঝার সুবিধার জন্য কাগুজে সোনায় লগ্নি বলতে গোল্ড ইটিএফ-কেই বুঝব আমরা।
গোল্ড ইটিএফ কী?
• পুরো কথা: গোল্ড এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড।
• বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড গোল্ড-ইটিএফ বাজারে ছাড়ে। ওই তহবিলে সংগৃহীত টাকা দিয়ে সোনা কেনে সংশ্লিষ্ট ফান্ড। আপনার টাকায় যতটা সোনা কেনা হবে, তার ভিত্তিতেই ইটিএফের ইউনিট পাবেন আপনি।
• অনেক সংস্থা এক গ্রাম সোনায় একটি ইউনিট দেয়। অনেকে আবার দেয় তার থেকে কমে। হয়তো প্রতি ০.১০ গ্রাম সোনার জন্য।
লগ্নি কী ভাবে?
• ফান্ডগুলি ইটিএফ বাজারে ছাড়লে, সরাসরি লগ্নি করা যায়। শেয়ারের মতো একেও বলে ইনিশিয়াল পাবলিক অফার (আইপিও)।
• তবে আইপিও-তে টাকা লাগাতে না-পারা মানেই কিন্তু এই নয়, যে সুযোগ ফস্কে গেল। কারণ, আইপিও-র পর ইটিএফ ইউনিটিগুলি শেয়ার বাজারে লেনদেন হয়। তাই সেই সময়েও ইটিএফে লগ্নি করতে পারেন। সুযোগ রয়েছে নিজের সুবিধামতো সময়ে তা ফের শেয়ার বাজারে বিক্রি করে লাভের টাকা ঘরে তোলার।
• ইটিএফ-ইউনিটের দাম নির্ভর করে মূলত সোনার দরের ওঠা-পড়ার উপর। |
|
প্রথম কাজ
• গোল্ড-ইটিএফ যেহেতু শেয়ার বাজারে লেনদেন হয়, তাই এর জন্য ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক। আইপিও এবং তার পর বাজারে কেনা-বেচা, দু’ক্ষেত্রেই তা জরুরি।
• আইপিও-র সময় ইউনিট কিনতে পারবেন সরাসরি মিউচুয়াল ফান্ডের কাছ থেকে। আর পরে হলে, তা কিনতে হবে ‘সেকেন্ডারি মার্কেট’ থেকে। ব্রোকারের মাধ্যমে।
সুবিধার খতিয়ান
• গোল্ড-ইটিএফে টাকা ঢেলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অল্প অল্প করে সোনা কিনতে পারেন আপনি। যা পরে বড় কাজে লেগে যেতে পারে। যেমন ধরুন, মেয়ের বিয়ে।
• ভেবে দেখুন, দীর্ঘ দিন ধরে এমন ভাবে সত্যিকারের সোনা কিনে জমাতে হলে, তা কেমন মাথাব্যথার কারণ হত। পায়ে পায়ে তাড়া করত চুরি-ডাকাতির ভয়। যা এড়াতে হয়তো ব্যাঙ্কের লকার ভাড়া নিতে হত আপনাকে। সেখানে গোল্ড-ইটিএফের মস্ত সুবিধা হল, এখানে সোনা চুরি যাওয়ার ভয় নেই। কারণ হয় তা রাখা থাকে ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্টে, নয়তো কাগজে। তাই লকারের খরচও বেঁচে যাওয়ার কথা।
• গয়না কিনলে খাদের প্রশ্ন রয়েছে। আছে মজুরির অঙ্কও। তাই ১০ গ্রামের হার ভাঙালে কিন্তু ১০ গ্রাম সোনাই হাতে পাবেন না। বাদ যাবে অনেকটাই। ইটিএফে সেই ঝামেলা নেই।
• ধরুন, আপনার কাছে সোনার বার কিংবা মুদ্রা আছে। যার বিনিময়ে নগদ টাকা প্রয়োজন। সমস্যা হল, ব্যাঙ্ক নিজে সোনার বার কিংবা মুদ্রা বিক্রি করলেও, তা আপনার কাছ থেকে কিনবে না। ফলে টাকার বিনিময়ে তা বিক্রির সুযোগ অন্তত ব্যাঙ্কে নেই। অধিকাংশ গয়নার দোকানও কিন্তু টাকা দিয়ে ওই বার বা মুদ্রা কিনতে চায় না। বড়জোর ওই সোনা কিংবা তার সমমূল্যের সোনা দিয়ে তারা আপনাকে কিছু গড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাত্, বদলাবদলি চলবে। বিক্রি নয়।
গোল্ড-ইটিএফে কিন্তু সেই অসুবিধা একেবারেই নেই। হাতে থাকা ইটিএফের ইউনিট দেশের যে কোনও প্রান্তে বসে বিক্রি করে দিতে পারেন আপনি। এবং সে ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়াটিও বেশ স্বচ্ছ।
• গোল্ড-ইটিএফে লগ্নি করলে, করছাড়ের সুবিধাও যথেষ্ট। যেমন
(১) এমনিতে সোনা সম্পদ করের (ওয়েল্থ ট্যাক্স) আওতায় পড়ে। কিন্তু গোল্ড-ইটিএফ তার বাইরে।
(২) ইটিএফের ইউনিট বাজারে শেয়ারের মতো কেনা-বেচা হলেও, সিকিউরিটিজ ট্রানজাকশন ট্যাক্স (হাতবদল হওয়া শেয়ারে যে কর বসে) এর উপর চাপানো হয় না।
(৩) সত্যিকারের সোনায় মূলধনী লাভ করে (ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্স) ছাড় পেতে অপেক্ষা করতে হয় তিন বছর। সেখানে গোল্ড-ইটিএফে তা পাওয়া যায় এক বছর পরেই।
ডি-ম্যাট না থাকলে গোল্ড ফান্ড
• যাঁদের ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁরা এই ঘুরপথে হেঁটে লগ্নি করতে পারেন গোল্ড-ইটিএফে। কারণ, গোল্ড ফান্ডে টাকা ঢালার জন্য ওই অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া, হয়তো আপনি শেয়ার বাজারের লেনদেনে তেমন সড়গড় নন। সে ক্ষেত্রেও গোল্ড ফান্ড আপনার পক্ষে বেশ যুতসই।
• বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড মাঝেমধ্যেই গোল্ড ফান্ড প্রকল্প বাজারে ছাড়ে। সংগৃহীত টাকা লগ্নি করা হয় ইটিএফে। যে ভাবে কোনও ফান্ড শেয়ার বা ঋণপত্রে লগ্নি করে, ঠিক সে ভাবেই গোল্ড-ইটিএফে টাকা ঢালে তারা।
কিস্তিতে সোনা
• এই পদ্ধতির নাম সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (এসআইপি)।
• মিউচুয়াল ফান্ডে যেমন এসআইপি-র মাধ্যমে (মাসিক কিস্তিতে) লগ্নি করার সুযোগ রয়েছে, তেমনটা রয়েছে গোল্ড ফান্ডেও। এখানেও মাসে অন্তত ৫০০ টাকা রাখতে হবে। তবে ইটিএফে এসআইপি-র সুবিধা নেই।
• এসআইপি-র বড় সুবিধা হল, এতে এক লপ্তে বড় টাকা ঢালার প্রয়োজন নেই। বরং প্রতি মাসে নিয়ম করে নির্দিষ্ট অঙ্ক লগ্নি করে যাবেন আপনি। ফলে অল্প অল্প করে সোনা জমতে থাকবে আপনার ঝুলিতে। একটা লম্বা সময় এ ভাবে চালিয়ে যেতে পারলে, তৈরি হয়ে যাবে সঞ্চয়ের বড়সড় তহবিল। তাই ছোট লগ্নিকারীদের জন্য এই প্রকল্প বেশ আকর্ষণীয়।
• অনেকে প্রতি মাসের একটা নির্দিষ্ট সময়ে টাকা জমা দেন। এতে লগ্নির শৃঙ্খলা বজার রাখতে সুবিধা হয়।
• এসআইপি পদ্ধতিতে গোল্ড ফান্ডে লগ্নি করার মানে গড় দামে সোনা কেনার সুবিধা। মনে করুন, কোনও মাসে আপনি যখন টাকা দিচ্ছেন, তখন সোনার দাম চড়া। তখন কিন্তু আপনার টাকায় একেবারেই অল্প সোনা কিনতে পারবে ফান্ড। তেমনই আবার অন্য মাসে কম দামের সুযোগে কিনে রাখবে একটু বেশি। তার মানে, দাম যখন বেশি, তখন সোনা কম কিনছেন আপনি। আর দর কম থাকলে, উল্টোটা। এর ফলে আখেরে লাভের সম্ভাবনা বাড়ে আপনারই।
তা বলে...
আমরা এখানে এসআইপির সুযোগ-সুবিধার খতিয়ান তুলে ধরলাম ঠিকই। কিন্তু তা বলে এক লপ্তে বেশি সোনা কেনাও বোকার কাজ নয়। আপনার যদি তেমন ট্যাঁকের জোর থাকে, তা হলে সেই পথেও হাঁটতে পারেন আপনি। তবে হ্যাঁ, সে ক্ষেত্রে একটু বেশি ঝুঁকি বইতে হবে আপনাকে।
|
এক দশকে অক্ষয়-তৃতীয়া |
বছর |
দাম* |
রিটার্ন** |
২০০৩
২০০৪
২০০৫
২০০৬
২০০৭
২০০৮
২০০৯
২০১০
২০১১
২০১২ |
৫৬৮
৬১১
৬৫০
১০২০
১০১৯
১২৬৭
১৬০৯
১৯৭২
২৩৪৯
৩০৭০ |
৬.৫২
৭.৬৯
৬.৩৩
৫৭.০১
-০.১৭
২৪.৩৫
২৭.০০
২২.৬০
১৯.০৯
৩০.৭৪ |
গড় |
|
২০.১২ |
* মুম্বইয়ে প্রতি গ্রাম পাকা (২৪ ক্যারাট) সোনার দাম টাকায়
** রিটার্ন(%) আগের বছরের সাপেক্ষে
*** তথ্যসূত্র ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল |
|
|
|
দোকানের বার/কয়েন |
ব্যাঙ্কের বার/কয়েন |
ইটিএফ/ গোল্ড ফান্ড |
খাদের ঝুঁকি |
নির্ভর বিক্রেতার উপর |
নেই |
নেই |
ফিরিয়ে কেনা |
কেনে কিন্তু কম দামে |
কেনেই না |
বিক্রি করতে পারেন |
নিরাপত্তার দায়িত্ব |
ক্রেতার |
ক্রেতার |
ফান্ডের |
সম্পদ কর |
দিতে হয় |
দিতে হয় |
দিতে হয় না |
|
লেখক রিলায়্যান্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সিইও
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|