বিজ্ঞপ্তি জারির পরে এক মাস কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখনও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম তৎপরতাও নেই স্বাস্থ্য দফতরের। ফলে কাগজে-কলমে ১ মে থেকে রাজ্যে গুটখা এবং তামাক ও নিকোটিন দেওয়া পানমশলা নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে সর্বত্রই তা দেদার বিকোচ্ছে। কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও আবার গোপনে। স্বাস্থ্যকর্তারা মানছেন যে, দায়িত্বটা তাঁদেরই। কিন্তু কী ভাবে এই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ হবে, সেই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর তাঁরা দিতে পারেননি।
মুখের ক্যানসারের প্রকোপ ঠেকাতে এ রাজ্যে গুটখা ও তামাক দেওয়া পানমশলার বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অনুযায়ী গত ২২ এপ্রিল বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়। কিন্তু তার পরে বিষয়টির প্রয়োগ কী ভাবে হবে, সে নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই তৈরি হয়নি।
কলকাতার বেশ কিছু দোকানে কথা বলে জানা গিয়েছে, এই নিয়মের কথা কেউ জানেনই না। কেউ কেউ আবার জানেন, কিন্তু তাঁরা নিঃসংশয় যে, এই নিয়ম না মানলেও কোনও ক্ষতি নেই। কেন স্বাস্থ্য দফতরের তরফে এই নিয়মটি প্রচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না? স্বাস্থ্য দফতরের জনস্বাস্থ্য বিভাগের যুগ্ম সচিব দেবাশিস বসু বললেন, “এটা না জানার মতো তো কিছু নেই। সরকারি তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করার পরে সকলেরই কোনও না কোনও ভাবে এটা জেনে যাওয়ার কথা।” |
রাস্তায় নেমে বিক্রি বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার? দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, “স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরাই নমুনা সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী মাসের শেষে সেই নমুনা পরীক্ষা করে দেখা হবে পরিস্থিতিটা আদতে কী রকম।” সেই নমুনা সংগ্রহ কি শুরু হয়েছে? তাঁর জবাব, “হওয়ার তো কথা। আমি ঠিক জানি না।”
পরিদর্শনের জন্য কি বিশেষ কোনও দল গঠিত হয়েছে? দেবাশিসবাবু বলেন, “আলাদা কোনও দল নয়, খাবারের মান নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, এটাও তাঁদেরই করার কথা। নমুনা সংগ্রহ করে যদি দেখা যায়, তাতে নিকোটিন রয়েছে, তা হলে ফুড সেফটি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু শুধু দোকান তো নয়, রাস্তাঘাটে, এমনকী ট্রাফিক সিগনালেও অহরহ হাতে প্যাকেট ঝুলিয়ে গুটখা বিক্রি করেন অনেকে। বহু দোকানে সামনে না ঝুলিয়ে রাখলেও গোপনে গুটখা বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার নিষিদ্ধ জিনিস বিক্রির জন্য বেশি দামও নেওয়া হচ্ছে ক্রেতাদের থেকে। এগুলো আটকানো যাবে কী করে? এই প্রশ্নের কোনও নির্দিষ্ট উত্তর তিনি দিতে পারেননি। তাঁর কথায়, “সবটাই ধাপে ধাপে ভাবতে হবে।”
প্রশাসনিক শীর্ষ মহলের ব্যাখ্যা, বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা প্রয়োগের দায়িত্ব পুরসভা-সহ বিভিন্ন দফতরের। বিভিন্ন কারণে সর্বত্রই এখন লোকবলের অভাব। তাই প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। তার অর্থ এই নয় যে বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিছু দিনের মধ্যেই নির্দেশ মেনে কাজ শুরু হবে।
ঠিক যে ভাবে প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধের আইন করেও তা প্রয়োগ করতে পারেনি রাজ্য সরকার, সে ভাবেই গুটখা সংক্রান্ত আইনও স্রেফ সরকারি নথিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে চিকিৎসক মহলের আশঙ্কা। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “রাস্তাঘাটে, মহাকরণ-সহ অন্যান্য সরকারি দফতরে অবাধে ধূমপান চলছে। কেউ মানে না। এই স্বাস্থ্য ভবনেই বহু কর্মী গুটখা খান। তাঁরা পর্যন্ত অভ্যাস বদলাননি। তা হলে আর অন্যত্র কী আশা করব?”
এর আগে কেরল, মধ্যপ্রদেশ, বিহার এবং মহারাষ্ট্রেও গুটখা নিষিদ্ধ হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, এ দেশে যত মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তার মধ্যে ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী তামাক। পূর্বাঞ্চলে ক্যানসার আক্রান্তদের মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে বিভিন্ন মহল থেকেই স্বাগত জানানো হয়েছিল।
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ইদানীং ধূমপানের মতো নেশার চেয়ে গুটখার নেশা বাড়ছে। কারণ, এর খরচ কম এবং যে কোনও জায়গাতেই খাওয়া যায়। যদি সরকার এই নিয়ম প্রয়োগ করতে পারে, তা হলে পাঁচ-সাত বছর পরে রাজ্যে মুখের ক্যানসার অন্তত ২০ শতাংশ কমার আশা রয়েছে।” একটি ক্যানসার প্রতিষ্ঠানের তরফে ক্যানসার শল্য-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “গুটখা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি এবং সিগারেটের উপরে কর বাড়ানো এই দু’টি বিষয়ের কথাই অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র আমাদের সংগঠনকে জানিয়েছিলেন। আমরা সরকারের সেই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়েছি। পাশাপাশি আমাদের অনুরোধ, এর প্রয়োগের দিকটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন।” ক্যানসার গবেষক উৎপল সান্যালের কথায়, “মুখের ক্যানসারের প্রকোপ ঠেকাতে রাজ্য যদি এই নিয়মের প্রয়োগের ব্যাপারে কড়াকড়ি শুরু করে, তা হলে রাজ্যের ক্যানসার মানচিত্রটাই অনেকটা বদলে যেতে পারে।” |