প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন ধরেই। আজ, বুধবার থেকে রাজ্যে কার্যকর হচ্ছে তামাক অথবা নিকোটিন মিশ্রিত গুটখা, পান মশলার যাবতীয় ব্যবহার নিষিদ্ধ করার নির্দেশ। সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে প্রচার ও সচেতনতা শিবিরে নেমে পড়েছেন চিকিৎসকদের অনেকেই।
বস্তুত, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নানা সময়ে প্রকাশ্যেই তামাক মিশ্রিত গুটখা, পান মশলার বাড়াবাড়ি রকম ব্যবহারের কুফল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একাধিক সরকারি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে একদিকে মুখ, গলার নানা জটিল রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। গুটখা, পান মশলার থুতুতে ফ্যাকাশে লাল হয়ে যাওয়া হাসপাতালের করিডর, সিঁড়ি দেখে ক্ষোভ-বিরক্তি চেপে রাখতে পারেননি। মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে, “আগামী দিনে করিডর, সিঁড়ি নোংরা করতে দেখলে আপনাদেরই প্রতিবাদ করতে হবে।”
এতদ্সত্ত্বেও দেশের ১৮ রাজ্য পারলেও এত দিন গুটখা, পান পশলা নিষিদ্ধ করতে না-পেরে নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে তাঁর সরকার। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর চাপে ওই কাজ করতে রাজ্য দ্বিধায় কি না তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়। কেন্দ্রের তরফেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ওই নির্দেশ কার্যকর হওয়ায় খুশী চিকিৎসকেরা। |
সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এক বছরের জন্য রাজ্যে তামাক-নিকোটিন মিশ্রিত গুটখা, পান মশলা ব্যবহার, মজুত পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ তা মজুত, ব্যবহার করলে কিংবা সেই কাজে মদত দিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। সরকারি তরফে অভিযুক্তকে জরিমানা করে শাস্তি দেওয়া হতে পারে। রাজ্যের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক কমিশনার দেবাশিস বসুর তরফে দেওয়া সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে সব দিক খতিয়ে দেখেই ১ মে, ২০১৩ থেকে এক বছরের জন্য যে কোনও নামের গুটখা, পান মশলা (যাতে নিকোটিন, তামাক মিশ্রিত রয়েছে) ব্যবহার, মজুত পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
রাজ্যের বিধানসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “তামাক-নিকোটিন মিশ্রিত গুটখা যে শরীরের পক্ষে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক তা চিকিৎসক মাত্রই জানেন। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগেই তা ব্যবহার ও মজুত নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করব, রাজ্যের সমস্ত বাসিন্দা নির্দেশ মেনে চলবেন।”
গুটখা, পান মশলার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া গোটা দেশে শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ২০০৫ সালের ২ অক্টোবর মাসে গোয়ায় গুটখা, পান মশলা নিষিদ্ধ হয়। ২০১২ সালের মধ্যে কেন্দ্রশাসিত আন্দামান ছাড়াও বিহার, ছত্তীসগঢ়, দিল্লি, গুজরাত, হিমাচল, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মিজোরাম, পাঞ্জাব, রাজস্থান, সিকিমে গুটখা, পান মশলা নিষিদ্ধ হয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি উত্তরাখণ্ড ও ওড়িশা সরকার ওই দুটি বস্তু নিষিদ্ধ করে দেয়। পরে মার্চ মাসে অসমে, এপ্রিলের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশে গুটখা নিষিদ্ধ হয়।
ঘটনা হল, গোটা দেশেই গুটখা, পান মশলা ব্যবহার ও মজুত নিষিদ্ধ করার জন্য দীর্ঘদিন আগেই দাবি উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চায় একটি সংস্থা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপের পরে কেন্দ্রও ২০১১ সালে খাদ্য নিরাপত্তা আইনের আওতায় তামাক ও নিকোটিন মিশ্রিত গুটখা, পান মশলা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পর্যায়ক্রমে তা রাজ্যগুলি বলবৎ করছে।
ওই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছেন শিলিগুড়ি হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিষয়ক শল্য চিকিৎসক রাধেশ্যাম মাহাতো। তিনি নিজেই সরকারি নির্দেশিকা জেরক্স করে তা প্রচারপত্র আকারে বিলির কাজও শুরু করেছেন। রাধেশ্যামবাবু বলেন, “গুটখা, পান মশলার নেশার ফলে গলা ও তার উপরের অংশে ক্যানসারের আশঙ্কা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখছি বড়দের মধ্যে তো বটেই, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও গুটখা ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ায় মুখ, গলায় নানা জটিল রোগ হচ্ছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে অঙ্গহানি, মৃত্যুও ঘটার আশঙ্কা থাকে। তাই আমরা ওই নির্দেশিকা সামনে রেখে প্রচার। সচেতনতা শিবিরে জোর দিয়েছি।”
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ শেখর চক্রবর্তী জানান, দীর্ঘদিন গুটখা, পান মশলা ব্যবহারের ফলে পেটের তো বটেই, শরীরে নানা ধরনের জটিল রোগের আশঙ্কা রয়েছে। শেখরবাবু বলেন, ‘‘কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ হলে কাজ হবে না। বাস্তবে আমরা যেন সকলেই ওই নির্দেশ মেনে চলায় জোর দিই, সে দিকে সকলকে খেয়াল রাখতে হবে।” |