‘বি’-পথে বিপদ ২...
‘পাঁড়িকা’কে বশ মানানো উন্নয়ন দেখেনি গাছেরা
ঙ্গলমহলে উন্নয়ন কি ‘পাঁড়িকা’ ধরার জন্য!
কথা হচ্ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের এক তৃণমূল নেতার সঙ্গে। পরিবর্তনের জমানায় মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, “পাঁড়িকা তিতির জাতীয় পাখি। একটা পাখিকে বশ মানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। যাতে তার পিছুপিছু অন্যেরাও খাঁচায় চলে আসে। পাঁড়িকা এখানে মাওবাদী ও তাদের সমর্থকেরা। আর তাদের বশ মানাতে দরকার উন্নয়ন।”
প্রশ্ন হল, জঙ্গলমহলের উন্নয়ন কি ‘পাঁড়িকা’ ধরতে পারছে? কিংবা ‘পাঁড়িকা’ ধরা পড়লে তার কারণ কি নেহাতই উন্নয়ন?
ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি ব্লক সদর থেকে পশ্চিম দিকে এঁকেবেঁকে গিয়েছে পথ। কোথাও মোরাম, কোথাও পাথুরে রাস্তা। ১৬ কিলোমিটার দূরে জামাইমারি গ্রাম। পশ্চিমবঙ্গের শেষ বিন্দু। রাস্তার এক পাশে এ রাজ্য, উল্টো ফুটে ঝাড়খণ্ডের পাকুড়িয়া। জামাইমারি গ্রামে সনৎ মুর্মুর (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে দেখা এক ৪২ ডিগ্রির দুপুরে। আট কিলোমিটার দূরে খোট্টাধরায় যৌথবাহিনীর শিবির থেকে একটু আগেই ঘেমেনেয়ে গ্রামে ঢুকেছেন সনৎ। কেন গিয়েছিলেন?
জুনিয়র কনস্টেবলের পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য, উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ যুবক বলেন, “দু’দিন আগে এলাকায় মাওবাদীদের ছ’জনের একটা দল ঢুকেছিল। মদন মাহাতো ছিল নেতৃত্বে। সঙ্গে দিলীপ মাহাতো, রেখা ও আরও দু’জন। প্রত্যেকের সঙ্গেই হাতিয়ার ছিল। এই খবরটাই দিয়ে এলাম।” ভয় করল না? “পুলিশ আমাদের বড় ভরসার জায়গা। ওদের জন্যই আমরা শান্তিতে আছি।”
পশুপতি কিস্কু। স্নাতক হয়েও কাজ না পেয়ে ফি বছর পুবে খাটতে যান।—নিজস্ব চিত্র।
জামাইমারিতে রাতবেরাতে মোটরবাইকে পুলিশ ঢোকে। তবে এ রাজ্যের নয়, ‘জাপ’ (ঝাড়খণ্ড আর্মড পুলিশ)। ঝাড়খণ্ড সরকার পশ্চিম মেদিনীপুর লাগোয়া পূর্ব সিংভূম জেলার ওই অংশে ঢালাই রাস্তা গড়ে দিয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যের জঙ্গলমহলে গ্রামীণ রাস্তার কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশের সাম্প্রতিক চিঠি। কেন্দ্র জানিয়েছে, রাজ্য প্রকল্প রূপায়ণে গতি না বাড়ালে জঙ্গলমহলের তিন জেলায় গ্রামীণ রাস্তা গড়ার জন্য এখনই টাকা বরাদ্দ করা সম্ভব নয়।
রাজ্য তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা মানছেন, “অস্বীকার করার উপায় নেই মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল সমান ভাবে পৌঁছচ্ছে না। ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। সেটাকেই হাতিয়ার করছে মাওবাদীরা।” ওই নেতার সংযোজন, “নতুন করে জনসমর্থন জোগাড় করাটাই এখন মাওবাদীদের প্রধান লক্ষ্য। আমাদের সরকারের কাজকর্মের কিছু ত্রুটি ওদের সেই সুযোগ করে দিচ্ছে।” তবে জামাইমারির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট, অনুন্নয়ন মানেই মাওবাদী সমীকরণটা এত একমাত্রিক নয়। গ্রামবাসীর কথায়, “সরকার যে উন্নয়ন করেনি, সে কথা আমাদের বার বার বলে মাওবাদীরা। কিন্তু রাস্তা ভাল হোক, যোগাযোগ ভাল হোক, সে কথা কখনও বলে না। তা হলে যে ওদের অসুবিধে!”
আসলে এই তল্লাটের মানুষজন মাওবাদীদের জুলুম ভুলতে পারেননি। অভাব-অনটন-অনুন্নয়ন আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল বলে মনে করেন তাঁরা। আর স্বস্তি মানে মাওবাদীদের জুলুম থেকে রক্ষা। এর কৃতিত্ব তাঁরা পুরো দিচ্ছেন পুলিশ তথা যৌথবাহিনীকেই। জামাইমারি থেকে বেলপাহাড়ির পথে লবনি গ্রামের রেবারানি সিংহ ও মহাদেব সিংহরা বলছেন, “পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে। পুলিশ যতদিন থাকে, ততদিন ভাল।”
এলাকায় কেন্দ্রীয় প্রকল্পে উন্নয়নের কাজকর্ম চোখে পড়ে। ‘ইন্টিগ্রেটেড অ্যাকশন প্ল্যান’-এ পানীয় জলের ট্যাঙ্ক বসেছে গ্রামে-গ্রামে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার আওতায় যে-রাস্তা ছিল পাথুরে ও এবড়ো-খেবড়ো, সেখানে এখন মোরাম পড়েছে। রাজ্যের তরফে আছে দু’টাকা কেজি-র চাল বিলি এবং এনভিএফ, সিভিক পুলিশ বা জুনিয়র কনস্টেবল পদে নিয়োগ। এলাকা ঘুরে মনে হয়, ‘পাঁড়িকা’কে বশ মানানোর পিছনে এই চাকরি এবং দু’টাকা কেজি-র চালের অবদান আছে।
তবে জামাইমারির খেপা মুর্মু, বাঁকুড়ার বারিকুলের বুড়িশাল গ্রামের ধনমণি সোরেনদের অভিজ্ঞতা অন্য। তাঁরা জানেন, ৫০ কেজি পাথর ভেঙে আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুট কাঠের পেটিতে ভরতে পারলে মিলবে ৬০ টাকা। সমর্থ লোক দিনভর বড়জোর দু’পেটি পাথর ভাঙতে পারে। যাঁরা পাথর ভাঙায় দড় নন, তাঁরা আছেন জঙ্গলের ভরসায়। সেখানে পাওয়া তিন আঁটি কাঠ বেচলে গড়ে ৮০-১০০ টাকা, শালপাতা ১০০ গ্রাম ১০ টাকা, ওই পাতা ১,০০০ সেলাই করলে দৈনিক ৮০-১০০ টাকা, বাবুইঘাসের দড়ি ১২-১৮ টাকা কেজি (সপ্তাহে বড়জোর ৩০ কেজি দড়ি পাকাতে পারেন পোক্তরা), কেন্দুপাতার চাটা (২,০০০ পাতা) ৪৫-৭৫ টাকা, মরসুমে মহুল ফুল (মহুয়া বানানোর উপাদান) এক কিলো ১০-১৫ টাকা মোটামুটি রোজগারের উপায় বলতে এই।
আদিবাসী-প্রধান রাঢ়বঙ্গের এই এলাকাগুলো চরিত্রে পুরুলিয়ার বলরামপুর, বান্দোয়ানেরই দোসর। চাষিদের একটা বড় অংশ প্রান্তিক। ব্যক্তিগত জমি স্বল্প। ধান হয় বছরে এক বার, তা-ও যদি ‘দেবতারা প্রসন্ন হন’, মানে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়। প্রায় ঊষর জমি চাষ করে পেট চলে বড়জোর মাস পাঁচেকবলছিলেন বারিকুলের রাওতড়া পঞ্চায়েতের মেরালডি গ্রামের পশুপতি কিস্কু। খাতড়া কলেজ থেকে বছর চারেক আগে স্নাতক হওয়া পশুপতি এখন ফি বছর পুবে (বর্ধমানে) খাটতে যান। মজুরি দৈনিক ১৩০-১৫০ টাকা।
মাস তিনেক পূবে খেটে ফিরলে সেই আয়ে টেনেটুনে চলে বাকি চার মাস। ‘‘তা হলে বলুন, উন্নয়ন কোথায়?’’ জানতে চান পশুপতি। একই প্রশ্ন লাগোয়া গ্রাম বুড়িশালের নির্মল টুডু ও লালমোহন মান্ডির। রাওতড়া পঞ্চায়েতের ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির প্রধান কালীরাম হেমব্রম মানছেন, ওই এলাকাতেই রয়েছে এলাকার অন্যতম পিছিয়ে পড়া মৌজা কাওয়াটাঙা, যেখানে রাস্তা-সমস্যার পাকাপাকি কোনও সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
কাওয়াটাঙা জঙ্গল এলাকাতেই সাত-আট মাস আগে চার-পাঁচ জন মাওবাদীর একটি দল ঝাড়খণ্ড থেকে তাড়া খেয়ে ঢুকেছিল বলে পুলিশের দাবি। বারিকুল থানার এক অফিসার বলেন, “স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে ওরা পাথরভাঙার কাজ করছিল। এখন অবশ্য তারা ওই এলাকায় নেই।” তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, “ওরা ফের আসছে। যাতায়াতটাই যা কমেছে।”
কী বলছেন মাওবাদীরা, অনুন্নয়ন নিয়ে কোনও কথা?
জামাইমারির ষাটোর্ধ্ব দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কষ্ট করে হাসেন। বলেন, “ওরা শুধু নিজেদের কথা বলে। মিটিংয়ে যেতে হবে। মিছিলে যেতে হবে। খাবার লাগবে।” সে কথা না শুনলে? “কী আবার, শাস্তি! মারবে-পিটবে। শাস্তি, অশান্ত
উন্নয়ন বা শান্তির ‘পাঁড়িকা’ পাকাপাকি ঘর বাঁধুকএটুকুই চায় এলাকার ‘গাছেরা’।

(শেষ)

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.