খোদাই করা চেহারার কালীরাম হেমব্রম অনায়াসে বলে দিলেন কথাটা। “মাওবাদীরা তো সাধারণ মানুষকে মারে না। যারা খারাপ কাজ করে, মানুষের ক্ষতি করে, ওরা তাদেরই মারে।” পড়শি যুবক শুকদেব টুডু আরও খোলামেলা। “আদিবাসীদের উন্নয়নের কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মুখেই বলছে। আসলে আদিবাসীরা বঞ্চিত হচ্ছেন সব দিক থেকে। লোকে তো এমনিতেই মাওবাদী হবে।” গ্রাম মাহুলিটাঁড়। ব্লক বলরামপুর। জেলা পুরুলিয়া। ২০০৯ কিংবা ২০১০-এর উত্তাল সময় নয়। ২০১৩। জঙ্গলমহল যখন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘হাসছে’।
মাওবাদী উপদ্রবের নিরিখে এক সময়ে প্রশাসনিক মানচিত্রে আলাদা গুরুত্ব পেত ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েত। ৬০-৭০টি পরিবারের এই গ্রাম সেই পঞ্চায়েত এলাকাতেই। অবস্থান, অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে। গা ঘেঁষে জঙ্গল। গ্রামের একাধিক বাসিন্দার বক্তব্য, “পাহাড়তলিতে আমাদের এই গ্রাম। ওরা নেমে এসে গ্রামে ঢুকলে আমরা কী করব?” |
গ্রামের অভিযোগ-তালিকা দীর্ঘ রাস্তা খারাপ। ইন্দিরা আবাস যোজনায় দুর্নীতি। গত বছর জবকার্ডধারীরা কাজ পাননি ১০০ দিনের প্রকল্পে। পানীয় এবং সেচের জলের অভাব। বিদ্যুৎ নেই। কিন্তু এমন তালিকা জঙ্গলমহলের আরও অনেক গ্রামে গেলেই মেলে। মাহুলিটাঁড়কে তাদের মধ্যে আলাদা ঠেকে, কারণ গ্রামীণ সমস্যার বৃত্তের বাইরেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে গ্রামবাসী যুবার একটা বড় অংশের। ভিড় করে তাঁরা বলছেন, “আদিবাসী পড়ুয়াদের বাংলা শিখতে সরকার বাধ্য করছে। ফুটবল খেলা দিয়ে মন ভোলানোর চেষ্টা হচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা বাড়ানোর দিকে মন নেই সরকারের। সরকার চায়, আমরা পিছিয়ে থাকি। পরিবর্তনের পরে আদিবাসীদের উন্নয়ন হয়নি, হয়েছে শাসক দলের নেতাদের”, রাজনীতির গন্ধ মাখা এমন মন্তব্য যাঁদের, তাঁরা কিন্তু জানাচ্ছেন প্রায় কেউই হাইস্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি।
“এ সব মগজধোলাই। অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে মাওবাদীরা কয়েকটি গ্রামে গিয়ে কিছু লোকের মগজধোলাই করছে,” বলছেন অঘোর হেমব্রম। এক সময়ে মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ আদিবাসী-মূলবাসী জনগণের কমিটির সম্পাদক অঘোরবাবু বিধানসভার আগে যোগ দেওয়ায় তৃণমূলের হাত শক্ত হয়েছে বলরামপুরে। বিধানসভায় সাড়ে দশ হাজার ভোটে সিপিএম-কে হারিয়েছিল তৃণমূল। মাহুলিটাঁড় যে-পঞ্চায়েতের অন্তর্গত, সেই ঘাটবেড়া-কেরোয়াও তৃণমূলেরই দখলে।
তা সত্ত্বেও দিনে-দুপুরে মাহুলিটাঁড়ের পথ দেখিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করতে বলরামপুরের বড় উরমা এলাকার তৃণমূল কর্মীরা আঁতকে উঠে বলেছিলেন, “ও বাবা, ও গ্রামে ঢুকতে পারব না। পথ চিনে চলে যান।” অথচ, প্রত্যন্ত গ্রাম বলতে যা বোঝায়, মাহুলিটাঁড় আদৌ সে রকম নয়। কুমারডি মোড়-ঘাটবেড়া পিচ রাস্তা থেকে বড়জোর এক কিলোমিটার দূরত্ব। কোনও জঙ্গলও পেরোতে হয় না গ্রামে ঢুকতে হলে। সাংবাদিকদের কাছে পরিচয় জানাতে গ্রামের যুবকেরা সময় নেন অন্তত মিনিট দু’য়েক। সন্দেহ থেকে যায়, আসল পরিচয় তাঁরা দিলেন কি না। আর মোবাইল নম্বর চেয়ে শুনতে হল, “কারও মোবাইল নেই। দরকারে আমরাই যোগাযোগ করে নেব।”
রাজ্য গোয়েন্দা শাখা ও যৌথ বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, মাওবাদীদের আনাগোনা বেড়েছে জঙ্গলমহলের চার ‘ব’-এবেলপাহাড়ি, বান্দোয়ান, বারিকুল ও বলরামপুর। রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত ডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) বাণীব্রত বসু বলেন, “বেলপাহাড়ি এলাকায় মদন মাহাতো, শ্যামল মাহাতোর স্কোয়াড এবং বলরামপুর ও অযোধ্যা পাহাড়ে রঞ্জিত পালের স্কোয়াড ঘুরছে। ওরা মাঝেমধ্যে ঝাড়খণ্ডের দিক থেকে আসছে। আমাদের কাছে যেটুকু খবর ওরা নতুন করে লোকও নিচ্ছে।” ওই পুলিশ-কর্তা জানান, ঝাড়খণ্ডের সীমানা এবং জঙ্গলঘেঁষা গ্রামগুলোয় মাওবাদীদের গতিবিধির খবর বেশি করে পাওয়া যাচ্ছে।
বলরামপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি নেতা সৃষ্টিধর মাহাতোও বলছেন, “মাওবাদীরা যে কয়েকটি গ্রামে যাতায়াত শুরু করেছে, সেটা অস্বীকার করি কী করে?” কিন্তু মাহুলিটাঁড় গ্রামে গিয়ে মনে হয়, মাওবাদী কার্যকলাপ সেখানে নিছক আনাগোনায় সীমাবদ্ধ নয়।
ওই গ্রাম থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে, অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে হেঁদলবেড়া গ্রামের অবস্থাও তথৈবচ। নলকূপ নেই, পুকুর নেই। বিধবা এবং বার্ধক্য ভাতা মেলে না বলে অভিযোগ। ১২ কিলোমিটার দূরে হাসপাতাল, সেখানে যেতে হয় ‘না-রাস্তা’ দিয়ে। অঘোর হেমব্রমের দাবি, “বেছে বেছে ওই সব এলাকায় মাওবাদীরা যাচ্ছে। আর খেপানোর চেষ্টা করছে।” ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েতের প্রধান, তৃণমূলের জিহুড় মাঝি স্বীকার করে নেন, “সকলকে তো সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, ১০০ দিনের কাজের টাকা বকেয়া রয়েছে। অনেক নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। বিদ্যুৎও পৌঁছায়নি অনেক জায়গায়। আর এই সব নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভকেই কাজে লাগাচ্ছে মাওবাদীরা।”
পুরুলিয়ারই সম্পূর্ণ অন্য দিকে কিন্তু ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বান্দোয়ান ব্লকের এক প্রত্যন্ত গ্রাম ঠরকাদহের বাসিন্দাদের অভিযোগ মিলে যায় মাহুলিটাঁড় কিংবা হেঁদলবেড়ার সঙ্গে। বান্দোয়ান সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের এই ঠরকাদহ লাগোয়া জঙ্গল থেকেই সম্প্রতি তাজা মাইন, জিলেটিন স্টিক পেয়েছে পুলিশ। পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণে ঝাড়খণ্ডের তিনটে থানা এলাকা (মানগো, পটমদা, পূর্ব সিংভূম) গিয়েছে গ্রামের গা ঘেঁষে। জঙ্গল-পথে সে সব জায়গা আধ ঘণ্টার বেশি দূরে নয়। কিন্তু ২ টাকা কিলো দরের চাল আনার ঠিকানা ভোমরাগড়া গ্রাম প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে। চাল আনতে গেলে এক দিনের মজুরি বরবাদ।
গ্রামে কি ফের বন-পার্টি (মাওবাদী) আসছে, খাবার-দাবার চাইছে? ঠরকাদহের রামু বাস্কে, প্রধান মুর্মুরা বলেন, “পোশাক তো সবারই এক। চিনব কী করে? আর খাবার তো দিতেই হবে। ওরাও তো মানুষ।” পাশের গ্রাম আসনপানিতেও মাওবাদী গতিবিধির খবর পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কুঁচিয়া পঞ্চায়েতের পদাধিকারীরা।
তবে কি কেবল অনুন্নয়নই কিছু জায়গায় মাওবাদীদের ঢোকার পথ করে দিচ্ছে? ঘাটবেড়া-কেরোয়া অঞ্চলের হিংমাংশু প্রামাণিক, ডাক্তার মাহাতোর মতো একাধিক তৃণমূল কর্মী অবশ্য ভাসিয়ে দিচ্ছেন অন্য ‘তত্ত্ব’। দাবি করছেন, “২০০৯-১০-এ মাওবাদীরা যখন এলাকায় দাপাচ্ছে, তখন সিপিএম ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। হ্যান্ডবিল দিয়ে দল ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছিল সিপিএমের এমন লোকেদেরও এখন আবার সক্রিয় রাজনীতি করতে দেখা যাচ্ছে। এত হিম্মৎ ওঁদের থাকার কথা নয়। মনে হয়, তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএম-কে মদত দিচ্ছে মাওবাদীরা।”
এ তত্ত্ব খারিজ করে বিধানসভা ভোটে বলরামপুরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত, সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপের যুক্তি, “আসলে মাওবাদীদের এখন খুনখারাপি করার ক্ষমতা নেই। তাই, বলরামপুরে আমাদের কর্মীরা আবার মাঠে নেমেছেন।”
মাওবাদীদের খুনখারাপি করার ক্ষমতা নেই না সিপিএমের লোকজনের গায়ে তারা এ যাত্রা হাত দেবে না? জঙ্গলমহলের রাজনীতির এই সম্ভাব্য রসায়নের বিস্তার কতটা, তা সময় বলবে। কিন্তু সব আলোচনা ঘুরেফিরে এখনও থমকায় সেই উন্নয়ন বা অনুন্নয়নে, যার সামান্য এ দিক-ও দিক জনতাকে প্রশাসনের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ছেঁদা খোঁজার জায়গা করে দেয় অনেককে।
|