পরীক্ষায় বসেছিল রেকর্ড সংখ্যক ছাত্রী। আশার আলো দেখেছিলেন অনেকে। কিন্তু ফল প্রকাশের পরে দেখা গেল, এ বারের হাই মাদ্রাসায় ছেলেদের তুলনায় খারাপ হয়েছে মেয়েদের ফলাফল। মেধা তালিকায় প্রথম কুড়ি জনের মধ্যে ছাত্রী মাত্র তিন জন। ৮৩.৫ শতাংশ ছেলে উত্তীর্ণ। মেয়েরা সেখানে ৭৪.৬৯ শতাংশ। কিন্তু কেন পিছিয়ে পড়ল মেয়েরা—কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে উঠে আসছে মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ। অবহেলা আর অনাদরের কথা।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সচিব সৈয়দ নুরুস সালামের বক্তব্য, “বাড়ির কাজ সামলে অনেক মেয়েই নিয়মিত ক্লাসে আসতে পারে না। পরিবারে মেয়েরা চিরকালই অবহেলিত। তাই তারা ভাল করতে পারছে না।” সত্যিই কি তাই?
পিছিয়ে পড়া এলাকার সংখ্যালঘু মেয়েরা অন্দরমহলেই কার্যত বন্দি থাকবে আগে এটাই ছিল দস্তুর। তবে এখন সে সব এলাকা থেকেও ছাত্রীরা মাদ্রাসায় আসছে। এমনই একটি এলাকা নদিয়ার চাপড়ায় বেলতলা ও ইসলামগঞ্জে দু’টি মাদ্রাসা রয়েছে। সেগুলিতে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রী বেশি। অথচ, মাদ্রাসাগুলির অদূরে চাপড়া ও দইয়ের বাজার এলাকার স্কুলগুলিতে ছাত্রেরা দলে ভারী। কেন এমন হচ্ছে? শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশের অভিজ্ঞতা, অনেক অভিভাবকের ধারণা, মাদ্রাসার তুলনায় স্কুলে পড়লে চাকরির বাজারে বাড়তি সুবিধা মেলে। তাই মেয়ে যাচ্ছে মাদ্রাসায়। ছেলে স্কুলে। বেলতলা জুনিয়র হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মফিজুল মল্লিক বলেন, “মেয়েদের একটু ‘পড়ানোর জন্য’ মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। আর ছেলেদের ‘মানুষ’ করার জন্যই বিভিন্ন আবাসিক প্রতিষ্ঠানে পাঠান অভিভাবকেরা। চাপড়া এলাকাতেই রয়েছে গোটা চারেক আবাসিক মিশন। সেখানে ছেলেদের পড়ানোর ঝোঁক প্রবল।”
দীর্ঘ দিন ধরে মুর্শিদাবাদের সংখ্যালঘু সমাজ নিয়ে গবেষণা করছেন ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ। তাঁর বিশ্লেষণ, “সংখ্যালঘু সমাজে দরিদ্র পরিবারের ছেলেরা একটু ‘বড়’ হলেই স্কুলছুট হয়ে যায়। পেটের তাগিদে ভিন্-রাজ্যে, এমনকী, বিদেশেও পাড়ি দেয় তারা। অন্য দিকে, যত দিন বিয়ের উপযুক্ত না হচ্ছে, তত দিন মেয়েরা স্কুলেই যাচ্ছে। ফলে, হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ছেলেদের তুলনায় বেশি মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে।” মাদ্রাসায় ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অধ্যাপিকা মিরাতুন নাহারের। তাঁর কথায়, “এখন সমস্ত ছেলেই চায়, শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করতে। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার তাগিদ থেকে অভিভাবকেরা মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। তা ছাড়া, ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সমস্ত মেয়েই শিক্ষার মর্ম উপলব্ধি করতে পারছেন। তাই তাঁরা শিক্ষামুখী। যার ফল, হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় মেয়েদের এই সংখ্যাধিক্য।”
তা হলে মেয়েদের ফল খারাপ হচ্ছে কেন?
মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশের মতে, সংখ্যালঘু সমাজে এখন অনেক বিবাহিত মহিলাও স্কুলে যান। তবে সংসারের কাজে জড়িয়ে যাওয়ায় পড়ার মান ঠিক রাখা তাঁদের পক্ষে কষ্টকর হয়। সংসারের চাপে পড়ে একই সমস্যা হয় দুঃস্থ পরিবারের অবিবাহিতা মেয়েদেরও। মিরাতুন নাহার বলছেন, “সমাজে এখনও লিঙ্গ-বৈষম্য প্রবল। পরিবারের যৎসামান্য সামর্থ্য দিয়ে ছেলেকে ভাল পড়াশুনো করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তারপরে মেয়েটার ভাগ্যে আর কিছুই জোটে না। তা ছাড়া, বাড়ির কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় পড়ার পরিবেশ জোটে না মেয়েদের। সংখ্যালঘু ছাত্রীদের জন্য আবাসিক স্কুলের সংখ্যা বাড়ানো হলে হয়তো এই সমস্যা কিছুটা মিটবে।”
রাজ্যে মোট ৫২২টি হাই মাদ্রাসা রয়েছে। সেগুলিতে কি উপযুক্ত পরিকাঠামো রয়েছে? অনেকেই মনে করছেন ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত সঠিক থাকলে, নিয়মিত ক্লাস হলে টিউশনির সুযোগ না পেলেও এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রী অকৃতকার্য হত না। শিক্ষকের যে ঘাটতি রয়েছেন সে কথা মেনেছেন বিধানসভায় সংখ্যালঘু বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বলেন, “ক্যাবিনেটের মিটিংয়ে তিন হাজার শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু গত বছরের মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের নিয়োগই আটকে রয়েছে আইনি জটে। তাই মাদ্রাসা গুলিতে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়াও রাজ্যের বহু মাদ্রাসায় পর্যাপ্ত ক্লাস ঘর নেই। বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে মাদ্রাসাগুলির ভবন, শৌচালয় তৈরির উদ্যোগ হাতে নেওয়া হচ্ছে। দুই চব্বিশ পরগনার ২৪টি মাদ্রাসাকে আবাসিক করার পরিকল্পনাও আছে।”
তবে সব পক্ষই মাদ্রাসায় ছাত্রীসংখ্যা বাড়ায় আশার আলো দেখছেন। যতই হোক, মেয়েরা পড়ছে।
|
নিরপেক্ষতার খাতিরে উত্তরপত্রে কোড নম্বর |
পরীক্ষক আর পরীক্ষার্থীর নাম, রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ইত্যাদি জানতেই পারবেন না। মূল্যায়নে নিশ্ছিদ্র নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে আগামী বছর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের খাতায় কোড নম্বর চালু করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সোমবার এ কথা জানান। ওই দুই পরীক্ষার খাতায় ছাত্রছাত্রীরা নাম, রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর লেখেন। এখন পরীক্ষকের কাছে সেই সব তথ্য সংবলিত উত্তরপত্রই মূল্যায়নের জন্য গিয়ে পৌঁছয়। এ বার বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কোডের ব্যবস্থা হচ্ছে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ জানিয়েছে, উত্তরপত্র তাদের কাছে পৌঁছনোর পরে নাম, রোল নম্বর ইত্যাদি লেখা পাতাটি ছিঁড়ে নেওয়া হবে। সেই জায়গায় একটি কোড দিয়ে উত্তরপত্র পাঠানো হবে পরীক্ষকের কাছে। ফলে পরীক্ষার্থীর নাম, রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বরের বদলে পরীক্ষক জানবেন শুধু ওই কোড। পরে কোডের সঙ্গে মিলিয়ে পরীক্ষার্থীর নম্বর দিয়ে ফল প্রকাশ করা হবে। ‘স্পট ইভ্যালুয়েশন’ বা এক জায়গায় বসে উত্তরপত্রের মূল্যায়ন করা যায় কি না, পর্ষদ ও সংসদকে তা-ও বিবেচনা করতে বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী তিনি বলেন, “একাধিক ক্যাম্প বা শিবির করে উত্তরপত্রের মূল্যায়ন করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলেছি। ১৫ দিনের মধ্যে পর্ষদ ও সংসদের মতামত জানাতে বলা হয়েছে।” পরীক্ষকেরা বাড়িতেই খাতা দেখেন। কিন্তু অনেক সময়েই রাস্তাঘাটে, ট্রেনের কামরায় উত্তরপত্র পাওয়া যায়। খাতা হারানোর ঘটনাও বেনজির নয়। এগুলো রুখতেই মন্ত্রীর এই উদ্যোগ বলে মনে করছেন অনেকেই। ব্রাত্যবাবু অবশ্য তা মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, “এটাই গোটা দেশের গ্রাহ্য পদ্ধতি। তাই এই পদ্ধতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে।” |