|
|
|
|
বিধবা-মঙ্গল/২ |
|
রাধারানির কৃপায় তিন ঘণ্টা
কীর্তন গেয়ে ৫ টাকা আয়
শঙ্খদীপ দাস • বৃন্দাবন |
|
রাধারানির পায়ে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন ওঁরা। বৃন্দাবনে এখন বিধবাদের সংখ্যা বিশ হাজারের বেশি।
বারো আনাই বাঙালি। রাধেশ্যামের নামটুকু সম্বল করে যে চরম বঞ্চনার
জীবন কাটাচ্ছেন ওঁরা, তাই নিয়ে আনন্দবাজারের প্রতিবেদন। |
পার্থিব-অপার্থিবের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা এক-এক জন বিধবা যেন এক-একটা গল্প-উপন্যাস। সেই গল্পগুচ্ছের সন্ধান করতে করতেই চলে আসা পত্থরপুরায় রঙ্গজি মন্দিরের কাছে ভগবান ভজনাশ্রমে।
স্বপ্নাদেশ পেয়ে নিরাশ্রয় বিধবাদের জন্য এই ভজনাশ্রম গড়েছিলেন নওলগড়ের শেঠ জানকীদাস পাটোদিয়া। ব্রজে বিধবার সংখ্যা বাড়ায় ভগবান ভজনাশ্রমও এখন তার শাখা বাড়িয়েছে। দু’বেলা ভজন হয় সেখানে। সকাল সাতটা থেকে দশটা। বিকেলে তিনটে থেকে সাড়ে ছ’টা। পুরনো ভজনাশ্রমটির তিনটি হলঘর। ভালো করে আলো না ফুটতেই তিনটি হলঘরই ভরে গেল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিধবায়।
কারও বয়স পঞ্চাশ, তো কারও নব্বই ছুঁই ছুঁই। কারও মাথা ন্যাড়া, কারও ধবধবে সাদা চুল ছোট করে ছাঁটা। কেউ সোজা হয়ে চলতে পারেন, তো কারও হাতে লাঠি। অনেকেরই দু’পায়ে দু’রকম চটি। হাতে ছোট-বড় প্লাস্টিকের বোতল।
টানা তিন ঘণ্টা রাধেকৃষ্ণ ভজন করতে করতে গলা শুকিয়ে যায়। তাই সঙ্গে জল রাখা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে টিনের চাকতির আকারের একটি টোকেন নিয়ে ঢুকে পড়েন সেখানে। তিন ঘণ্টা ভজনের পর ওই টোকেন ফেরত দিলে তবে পাঁচ টাকা পাওয়া যায়। দু’বেলা করলে দশ টাকা। সেই ভিড়ের মাঝে গিয়ে পড়লেই কনকলতা, ঝর্না দাসী, লতিকা, আশালতারা উৎসুক হয়ে ওঠেন। প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, “আজ কোনও বাটাবাটি হবে নাকি গো বাবু?” কীসের বাটাবাটি? কখনও সখনও শেঠেরা এলে কিছু চাল মেলে। কিছুটা ডাল, তেল। মাথাপিছু বাঁটোয়ারা হয়। আশালতা কানের কাছে মুখ এনে বলেন, “আশ্রমের লোকেদের এক নয়াও দিও না বাবা। যা দেওয়ার মায়েদের হাতেই দিও। নইলে ওরা সব সাবাড় করে দেবে।” কনকলতাও উৎসাহে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু ‘বাটাবাটি’ হবে না বুঝে নিরাশ হয়ে বসে পড়লেন।
লতিকাদের সাতকাহন নিয়েই কথা এগোচ্ছিল। বাধা হয়ে দাঁড়ালেন মাঝবয়সী এক সধবা মহিলা। ইনি আশ্রমের মাস মাইনে করা ‘জমাদারনি’। বিধবাদের ‘কন্ট্রোলার’। বললেন, “আপনি এ বার আসুন। ভজনাশ্রমের ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে কথা বলুন।”
ভজনাশ্রমের এক কোণে অফিসঘর। বৈঠকি মেজাজে বসে থাকা ম্যানেজারবাবুর মুখ-মিষ্টির খামতি নেই। কিন্তু মায়েদের ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করলেই ফোঁস করে ওঠেন। বলেন, “সরকার কী দেয়? এই তো সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, রাজ্য সরকার ওঁদের ভালমন্দের দায়িত্ব নিক। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী করছে?” পাকা হিসেব শুনিয়ে দেন “দিনে দু’বেলা তেত্রিশশো করে মা ভজন করেন। গেল মাস পর্যন্ত প্রতি বেলায় চার টাকা দিতাম, এখন পাঁচ টাকা। মাথাপিছু পাঁচ টাকা দিলে মাসে কত হয়, বছরে কত?” একটা মানুষের সারা দিনের খরচ কত? অসুখবিসুখ ডাক্তার-বদ্যি! দিনে দশ টাকায় হয়? তা যে হয় না, তা বুঝতে রকেট বিজ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না। ফোকলা বাবার আশ্রম, বালাজি আশ্রম বা ভগবান ভজনাশ্রমের বাইরে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ দাঁড়ালেই বোঝা যায়।
ভজন শেষ হতে মায়েরা সব হন হন করে রওনা দেন বাঁকেবিহারি মন্দির, গোবিন্দ দেব মন্দির, সেবাপুরা, রঙ্গজি মন্দিরের দিকে। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে কে আগে ভাল জায়গা নিতে পারেন! কেউ বা ছোটেন কাজের বাড়িতে। দেরি হলে গিন্নিমার মুখ ঝামটা শুনতে হবে। ঝর্না দাসীর গতরে এখনও তাকত রয়েছে। তাই গেরস্তের বাড়িতে কাজ করে দু’পয়সা হয়। বউ বাজারের স্বামীর সোনার দোকান ছিল। ছেলেরা এখনও সেই কারবার দেখে। লক্ষ্মী পালের তাই ভিক্ষা করতে বাধে।
আগরবাতির কারখানায় কাজ করে দিনে বিশ টাকার মতো উপরি রোজগার হয়। তা দিয়েই বাড়ি ভাড়ার খরচ জোগান, ‘ক্যালসিয়াম’ ওষুধ কেনেন। সরযূবালা, যমুনা দাসীর বয়সও নেই। ক্ষমতাও নেই। মন্দিরের বাইরে শুয়ে কাটান। ব্রজধামে যমুনাদের সংখ্যা কম নয়। কম করে হাজার চারেক হবে।
তুলনায় মন্দের ভালো রয়েছেন বিষ্ণুপ্রিয়া। বৃন্দাবনে পা দিয়ে ওঁর সঙ্গেই প্রথম দেখা হয়েছিল চৈতন্যবিহারে মহিলা আশ্রয় সদনে। স্কুল বাড়ির মতো লম্বাটে দোতলা বাড়ি। তাতে বড় বড় এক-একটা ঘরে কুড়িটা তক্তপোষ পাতা। বৃন্দাবনে সরকার পরিচালিত এমন চারটি আশ্রয় সদন রয়েছে। তাতে সাকুল্যে বিধবা রয়েছেন আটশোর কাছাকাছি। এর মধ্যে দু’টিতে অক্ষয় পাত্র নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দুপুরে খাবার সরবরাহ করে। রাতের খাবারের ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নিতে হয়।
সেই সঙ্গে ওষুধপত্রের খরচও রয়েছে। সে খরচ জোগাতে কেউ বালাজি আশ্রমে ভজন করেন। কেউ বা যান ফোগলাবাবা আশ্রমে বা রাধেশ্যাম মন্দিরে। সেখানে অবশ্য ভজনের জন্য টাকা মেলে না। মাঝে মাঝে চালডাল মেলে। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া উপায় নেই।
মহিলা আশ্রয় সদনে যাঁরা থাকেন তাঁদের সকলেরই পরিচয়পত্র রয়েছে। সে কারণে মাসে চারশো টাকা বার্ধক্য ভাতাও প্রাপ্য। কিন্তু সরকারের খতিয়ানই জানাচ্ছে, ভাতা সকলে পান না। বৃদ্ধারা কবুল করেন, টিপ ছাপ দিয়ে প্রায়ই টাকা হাতিয়ে নেয় আশ্রয় সদন। কখনও টাকা মেলে ছ’মাস পরে, কেটেছেঁটে।
ঘর মোছা, বাসনমাজার খাটুনি তো রয়েছেই। তবে সদনে বসে অবশ্য এ সব ক্ষোভ-অসন্তোষ নিয়ে কথা বলা চলে না। কেননা বিষ্ণুপ্রিয়া, গীতারা কথা বললে কেয়ারটেকার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু সন্ধ্যায় বালাজি মন্দিরে গিয়ে কথা বললে বেরিয়ে পড়ে সব অপকীর্তি। অন্নপূর্ণা, সুমতিদের মতো বিষ্ণুপ্রিয়াদেরও মৃত্যুর পর সৎকার নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। মৃত্যুর পর হাত-পা কেটে ব্যাগে পুরে যমুনায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে আশ্রয় সদনে। সরকারি তদন্তেই উঠে এসেছে সে খবর।
তবে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ইদানীং কিছুটা কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। বিধবারা যাতে ঠিক মতো পেনশন পান, যাতে ধর্মমতে তাঁদের সৎকার হয়, সেটা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এমন যন্ত্রণা নিয়ে বৃন্দাবনে পড়ে থাকাই বা কেন? জবাব দেওয়ার আগে এটা বলে নেওয়া ভাল, বৃন্দাবনের বিধবাদের কাহিনিমাত্রেই সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, কিংবা ধর্ম করতে এসে ছেড়ে যাওয়ার গল্প নয় কিন্তু। অনেকেই স্বেচ্ছায় আসেন। সংসারের মোহ ছেড়ে রাধারানির চরণে বাকি জীবন সঁপে দেওয়ার বাসনায়। ব্রজে মরলে স্বর্গ বাস হবে যে! সেই বিশ্বাসের কাছে সরকারি ব্যবস্থারই বা কী গুরুত্ব, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই বা কী? তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ আদালত একটাই, ‘রাধেশ্যাম’।
সেই ভরসাতেই তো তুফান মেলে চেপে চলে এলেন সবিতা আর শান্তি। ‘সবই গোবিন্দের ইচ্ছে!’
|
(শেষ)
|
পুরনো খবর: পারানির কড়ি জমাতেও ভিক্ষেই ভরসা |
|
|
|
|
|