প্রবন্ধ ২...
ক্যানসার নিবারণে পরশুরামের পথে
ধুনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ক্যানসার চর্চার ইতিহাসের সিংহভাগ দখল করে আছে স্তন ক্যানসার নিয়ে সন্ধান আর অনুসন্ধান। এই ইতিহাসের নানান পর্ব জুড়ে রয়েছে স্তন ক্যানসারের বিরুদ্ধে জনচেতনা জাগানোর পরিত্রাহী চেষ্টা, ‘স্ক্রিনিং’, ‘স্তনোচ্ছেদ’, কৃত্রিম স্তন আর বিচিত্র চিকিৎসার ক্রমোন্নতি। অবশেষে আমরা এখন এসে পড়েছি জিনসংস্কৃতির যুগে। জিন-এর প্যাঁচালো সিঁড়ির গায়ে আমরা এখন প্রাণের রহস্য খুঁজছি, ব্যাধিরও। এই সন্ধানবৃত্তির একটা ফল হল ক্যানসার জিন-এর ‘আবিষ্কার’। ‘ক্যানসারের জিন’ বলে আদতে কিছু নেই বটে, তবুও ‘বি আর সি এ’ নামের জিনগুলোকে জনপ্রিয় ভাষায় স্তন ক্যানসারের জিন বলা হয়। ভাষা ব্যবহারে আর একটু সতর্ক হলে অবশ্য বলা উচিত এগুলো হল একটি বিশেষ শ্রেণির জিন, যাদের বলা হয় ‘টিউমার সাপ্রেসর জিন’। শরীরের কোনও কোষ অতিমাত্রায় বিভাজিত হতে থাকলে টিউমারের উদ্ভব হতে পারে। ‘টিউমার সাপ্রেসর জিন’-এর কাজ হল সেই অতিমাত্রার বিভাজন থেকে কোষকে সংযত করে রাখা। এই জিনগুলো কোনও কারণে বিকৃত (মিউটেশন) হয়ে গেলে তাদের আরব্ধ কাজ আর করা হয়ে ওঠে না। এর পরিণতিতে কারও কারও ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তার মানে, কোনও মহিলার শরীরে যদি ‘বি আর সি এ’ জিনের বিকৃত রূপটি দেখা যায়, তা হলে অন্য মহিলাদের তুলনায় তাঁর স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি।
কিন্তু ঝুঁকি মানে কী? কোনও না কোনও ক্যানসারের ঝুঁকি আমাদের সকলেরই থাকে। কিন্তু সমগ্র জনসমাজকে হিসেবের মধ্যে ধরলে ক্যানসার হয় প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে মাত্র এক জনের। আবার ক্যানসার বললেই কিছু বলা হয় না; তার নানান ধরন আছে, তাদের চলনে, স্বভাবে আর চিকিৎসার ফলাফলে প্রভূত প্রভেদ আছে। স্তন ক্যানসারও তাই। অবশ্য কোন ক্যানসার ঠিক কেমন, তা আগেভাগে হলফ করে বলা কঠিন। কিন্তু, স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা আতঙ্কে থাকেন, তাঁরা ভাবেন, ক্যানসারটা দেখা দেওয়ার আগেই যদি তাকে খুঁজেপেতে আবিষ্কার করে ফেলা যায়, তা হলে একটা মারণ ব্যাধি থেকে মুক্তি মিলবে। এমন একটি ধারণা বেশ কিছু কাল যাবৎ প্রচারিত হয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অবশ্য এ কথাই প্রমাণ করে যে, যে কোনও ক্যানসার নিয়েই ‘আগেভাগে জেনে নেওয়ার’ চেষ্টায় উপকারের সম্ভাবনা নেহাতই যৎসামান্য, আর বিভ্রান্তির আশঙ্কা তার চেয়ে অনেক বেশি। আর সবচেয়ে বড় কথা, এতে ক্যানসার-জনিত মৃত্যুর আশঙ্কাও কমে না।
কথাটা মেনে নিয়েও অনেকে বলেন, কিছু মহিলার বেলায় স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অন্যান্যদের তুলনায় বড্ড বেশি। যেমন, যাঁদের পরিবারে কোনও না কোনও নিকটতম আত্মীয়দের স্তন ক্যানসার ধরা পড়েছে এবং যাঁদের শরীরে ‘বি আর সি এ’ জিনের বিকৃত রূপটা ধরা পড়েছে। তাঁদের তো বছরে এক বার স্তন ক্যানসার সন্ধানের পরীক্ষাগুলো করাই উচিত। এই ঔচিত্যবোধ কিন্তু মানবিকতার সহজ শর্তগুলোর পরিপন্থী। কারণ, যে সব মহিলার স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি এমনিতেই বেশি, তাঁদের উপর বার বার ওই ধরনের পরীক্ষা করা বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকর। শুধু মানবিকতার দিক থেকেই না, সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক এবং বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও ‘আগেভাগে ক্যানসারের সন্ধান’ গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তা হলে কি আমরা আমাদের শরীরে বিকৃত জিনটাকে খোঁজার চেষ্টা করব না, যাকে বলে জিনেটিক স্ক্রিনিং? উত্তরটা নিশ্চয়ই আমাদের পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করবে না। করবে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আর কাণ্ডজ্ঞানের উপর।
‘বি আর সি এ’ নামে যে জিনগুলো নিয়ে এত উথালপাথাল, তারা স্তন ক্যানসারের জিন না। সকলের শরীরে একই জিন থাকে। ‘বি আর সি এ’ জিনগুলোও সকলের শরীরেই থাকে। শরীরের সুস্থ, স্বাভাবিক বিকাশের জন্য এই জিনগুলোর দরকার পড়ে। তাদের বিকৃত রূপগুলো এমনকী, সুস্থ, স্বাভাবিক শরীরেও থাকতে পারে। তা নিয়েই কোনও ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। এই জিনটা নিয়ে যে এত কথা হয়, তার একটা কারণ অবশ্য আছে। বৈজ্ঞানিকরা এক সময় দেখেছিলেন যে, কোনও কোনও ব্যক্তির শরীরে আগে থেকেই বংশগত ভাবে, ত্রুটিযুক্ত জিন-সন্নিবেশ (জিনোম) রচিত এবং সঞ্চিত হয়ে থাকে। সন্তান উৎপাদনের সময় এই ত্রুটিযুক্ত জিনগুলো কোনও কোনও সন্তানের মধ্যে সরবরাহ হয়ে যায়। এগুলোকে বলা হয় ‘প্রি ডিসপোজিশন জিন’। তাঁরা বলেছিলেন, এমন ত্রুটিযুক্ত জিন যাঁদের শরীরে আছে সেই সব সন্তানের ভবিষ্যতে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা প্রচুর। কিন্তু তাঁদের এই ব্যাখ্যাগুলো নিয়ে সংশয় অনেক। কারণ, ওই ব্যাখ্যা বাস্তবে ঠিকঠাক মেলে না। এ ধরনের ঘটনা ঘটে ঠিকই, তবে তা খুবই কম। তা ছাড়া, শরীরে তেমন নষ্ট-জিন থাকলেই যে ক্যানসার অবধারিত, এমন মোটেই না। যেমন, মহিলাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি যদি ১০% হয়, তা হলে যাঁদের শরীরে ‘বি আর সি এ’র নষ্ট রূপ থাকবে তাঁদের বেলায় ঝুঁকিটা বেশিই। বেশি মানে, ৭০ বছর বয়সে তাঁদের স্তন ক্যানসারের আশঙ্কা থাকবে ৩০% থেকে ৭০%। মুশকিল এই যে, ৭০ বছর বয়সে ক্যানসারের বা অন্য কোনও ব্যাধির আশঙ্কা কার না থাকে?
তা সত্ত্বেও কেউ কেউ পরশুরামের মতো বিশ্বকে ‘নিঃক্ষত্রিয়’ করার সাধনায় মেতেছেন। তাঁরা ‘ক্ষত্রিয়’ জিনগুলোর সন্ধান করে মহিলাদের উত্ত্যক্ত করেন যে, এ বার স্তনোচ্ছেদ করিয়ে কৃত্রিম স্তন লাগিয়ে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। স্তন না থাকলে স্তন ক্যানসার না হয় না-ই হল; কিন্তু ওই নষ্টজিন যাঁদের থাকে, তাঁদের বেলায় তো শুধু স্তন ক্যানসারই না, ডিম্বাশয়ের ক্যানসার, ডিম্ববাহী নালির ক্যানসার, এমনকী অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকিও বেশি। ওই ক্যানসারগুলো যে তাঁদের মুক্তি দেবে, তেমন কথা তো নেই। তাই, কতটা ত্যাগ স্বীকার করে কতটা স্বস্তি পাওয়া যাবে, সে প্রশ্নের কোনও সদুত্তর জিনসংস্কৃতিতে মেলে না। তা ছাড়া শুধু মহিলারাই বা কেন, বিকৃত ‘বি আর সি এ’ জিন তো পুরুষদের মধ্যেও থাকতে পারে। অথচ তাতে পুরুষদের স্তন ক্যানসার বা প্রস্টেট ক্যানসারের আশঙ্কা আছে কি না, তা আজও স্পষ্ট হয়নি।
সমস্যা এখন এই যে নষ্টজিন যদি শরীরে থাকেই, তো তাকে নিয়ে মানুষ যাবেন কোথায়? কোথাও তো নিরাপত্তা নেই। বিজ্ঞানের কাছেও নেই। কিন্তু বিজ্ঞান অন্তত সুপরামর্শ তো দিতে পারে। সে তো এ কথা বলতে পারে, ক্যানসার হলেই যে তা মৃত্যুর পরোয়ানা, তা তো না। ক্যানসার নিয়েও মানুষ দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারেন— ক্যানসারের চিকিৎসা করিয়ে বা এমনকী, না করিয়েও। এ যে কাল্পনিক স্তোকবাক্য না, সে কথা তো এখন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। সে তো বলতে পারে যে, তেমন দুর্ঘটনা যদি ঘটেও বা, আমরা তোমার পাশেই আছি। উন্নত বিজ্ঞান উন্নত পরিষেবা রোগীকে স্বস্তি দেবে। তার বদলে যদি কেবল আতঙ্কের গল্প ছড়ানো হয়, তা হলে তা আতঙ্কবিজ্ঞান হতে পারে, চিকিৎসাবিজ্ঞান না। অথবা আতঙ্কের শিহরন জাগানো তার কাজ না। আতঙ্ক জাগিয়ে উত্তরোত্তর অঙ্গোৎপাটন করে ‘প্লাস্টিক মানুষ’ তৈরি করা বৈশ্যের আশীর্বাদপুষ্ট কারুশিল্প হতে পারে, চিকিৎসাবিজ্ঞান না।
কিন্তু এখন চলছে জিনচর্চার যুগ; সমষ্টিগত সুড়ঙ্গ দর্শনের যুগ (Collective Tunnel Vision)। শত শত বিজ্ঞানীর পর্বতপ্রমাণ মেধা প্রাতিষ্ঠানিকতা আর বৈশ্যতন্ত্রের খবরদারির কাছে মাথা নত করেছে। মেধাশক্তির এমন নির্বোধ অপব্যয় পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও কখনও হয়েছে কি না, আমাদের জানা নেই। তাই ক্যানসারের আতঙ্কটা জেনে-বুঝে ছড়ানো হয়েছে। তার পরিণতি হল ক্যানসার থেকে পূর্বাহ্ণেই পরিত্রাণ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। মনে পড়ে, ক্যানসার নিবারণের উপর একটি বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে এক পণ্ডিত লিখেছিলেন, এই ঢাউস বইটা পড়ে ঠিক বোঝা গেল না কী ভাবে ক্যানসার-নিবারণ সম্ভব, তবে একটি কথা আমি খুব বুঝেছি, তা এই যে, স্তন ক্যানসার নিবারণের শ্রেষ্ঠ উপায় হল বালিকাবেলায় স্তন দু’টি কেটে বাদ দেওয়া।
এমন ব্যঙ্গের পরেও কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রের অতি ব্যগ্র কর্মযোগীদের চোখ খোলেনি। নইলে অনাগত ক্যানসারের আশঙ্কায় এক একটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দেওয়ার পরামর্শ তাঁদের মাথায় আসে কী করে! তাঁরা তো এই কথাটাও ভেবে দেখলে পারতেন যে, ‘প্রি-ডিসপোজিশন জিন’ যদি এতই মারাত্মক হয়, তা হলে তো সব সাহেবের সাদা চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়াই উচিত, কারণ, কে না জানে, সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যেই ত্বক ক্যানসারের আশঙ্কা আর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি! আর সে-ও তো আসলে ওই জিনেরই কারবার।
আসলে মাত্রাজ্ঞান এখন ক্রমশ অপস্রিয়মাণ। অথচ আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র বা ‘মডার্ন মেডিসিন’ মানে তো মাত্রাজ্ঞানই। নইলে এমন তথ্যও তো আমাদের হাতে আছে যে, কাটাছেঁড়া না করে বরং ধূমপান করলে নাকি নষ্টজিন-বাহক মহিলাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায় ৫০%। এ বার তা হলে কী করা!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.