স্তন ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা প্রসারের দায়িত্ব। অ্যাঞ্জেলিনা সেই কাজটিই করলেন।
ডা. দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত |
খবরটা জেনে পৃথিবী জুড়ে বহু পুরুষের দু-তিনটে হৃৎস্পন্দন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। বহু নারী বুকে হাত দিয়ে আঁতকে উঠেছেন, মা গো, এই নৃশংসতার নাম ডাক্তারি! শক পাওয়ার মতোই খবর নিশ্চয়ই। হলিউডের শীর্ষ অভিনেত্রী, সৌন্দর্য আর যৌন আবেদনের মূর্ত প্রতীক অ্যাঞ্জেলিনা জোলি তাঁর স্তনযুগল কেটে বাদ দিয়েছেন সেখানে ক্যানসার আক্রমণের আশংকা ছিল বলে!
শুধু আশংকা ছিল বলেই? কতটা আশংকা? সে কথা স্পষ্ট করে বুঝতে গেলে আগে বিআরসিএ জিনের পরিচয়টা জানা দরকার। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি গবেষকরা বিআরসিএ-১ ও ২ নামে দুটি প্রাসঙ্গিক জিন শনাক্ত করেন। যে সব মহিলার দেহকোষে মিউটেশনগ্রস্ত বিআরসিএ-১ জিন রয়েছে, তাঁদের ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার আশংকা আশি শতাংশ পর্যন্ত স্বাভাবিকের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। ডিম্বাশয়ে ক্যানসার হওয়ার আশংকাও প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বেশি। অ্যাঞ্জেলিনা ছিলেন এই বিআরসিএ-১ পজিটিভ।
তবু... রোগ তো এখনও হয়নি, শুধু তার আশংকার জন্য এত বড় অঙ্গহানি? ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্যের রানি অ্যাটোসা তাঁর ক্রীতদাসকে দিয়ে রোগগ্রস্ত স্তনচ্ছেদন করিয়েছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্র কি এত দিনে আর একটুও এগোল না? মনে পড়তে পারে বছর কয়েক আগে বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে রাজ্য-জোড়া কালিংয়ের কথা। রোগ প্রতিরোধের জন্য এত নির্মম আয়োজনের বিরুদ্ধে অনেকেই তখন নৈতিকতার প্রশ্ন তুলেছিলেন।
অনেকে বলবেন, সেখানে হচ্ছিল প্রাণহানি আর এখানে প্রাণরক্ষা। ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স তো প্রচারে ফাঁপিয়ে তোলা ধারণামাত্র। শারীরতত্ত্বের চোখে স্তন মোটেও নারী শরীরের তেমন ভাইটাল কিছু নয়। নেহাতই এক সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্য। সচেতন ভাবেই ইংরেজি শব্দটি ব্যবহার করলাম, নয়তো স্তনকে অপ্রধান বা গৌণ অঙ্গ বললে বিজ্ঞানীকুলের সংবেদনশীলতার অভাবই প্রমাণ হবে।
তা সেই অঙ্গ কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া আর কি কোনও উপায় ছিল না? এখানেই নিউ ইয়র্ক টাইম্স-এ প্রকাশিত অ্যাঞ্জেলিনার চমকপ্রদ আত্মকথনটি প্রসঙ্গে সামান্য ভ্রু-কুঞ্চন। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর প্রবল ভাবে ইতিবাচক হ্যাঁ, বিজ্ঞানস্বীকৃত আরও উপায় ছিল। প্রথমত বিআরসিএ-পজিটিভ মহিলা ব্রেস্ট এম আর আই-এর মতো আধুনিক সংবেদী পরীক্ষা নিয়মিত করিয়ে গেলে অঙ্কুরেই রোগ মোকাবিলা করা সম্ভব। তা ছাড়া এই মহিলাদের স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে ট্যামোক্সিফেন ওষুধ প্রয়োগ করেও উপকার পাওয়া যাচ্ছে। তবে, অবশ্যই স্তন বাদ দেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি। ব্রেস্ট দুটিই যদি না থাকে, তা হলে ব্রেস্ট ক্যানসার হবে কোত্থেকে?
তাঁর মা, মার্শেলিন বারট্রান্ডকে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ক্যানসারে তিলে তিলে মরতে দেখার অসহায় স্মৃতি এতটাই দগদগে যে আটত্রিশের অ্যাঞ্জেলিনা তাই বেছে নিয়েছেন সবচেয়ে নিরাপদ পথটিকেই। তাঁর এই সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আরও কিছু বিরুদ্ধ কথা উঠতে পারে।
যেমন ১) মার্শেলিনের মৃত্যু হয়েছিল, যত দূর জানা যায়, ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে, স্তন ক্যানসারে নয়।
২) আগাম সাবধান হওয়ার জন্য বিআরসিএ-জিন পরীক্ষা করানোর খরচ সাধারণের আয়ত্তে নয়।
৩) স্তন পুনর্গঠন করানোয় এবং ‘সামান্য ক্ষত ছাড়া আর কিছু’ বোঝা যাচ্ছে না বলায় তাঁর মূল বক্তব্যের অভিঘাত অনেকটা হালকা হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ছিদ্রান্বেষণ এখন থাক। ক্যানসার আক্রান্ত ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যানসার সবার ওপরে: লাখে কুড়ি জন। যেখানে জরায়ু-মুখ (সারভিক্স) এবং ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ক্ষেত্রে অনুপাতটা যথাক্রমে ১৪.৪ ও ৫.৬। সুতরাং স্তন ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা প্রসার জরুরি। আর এ কাজে অ্যাঞ্জেলিনার মতো মানুষের সমানুভূতি প্রকাশের গুরুত্ব অবশ্যম্ভাবী। সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে, নিজের কেরিয়ারকেও বাজি ধরে সে দায়িত্ব পালন করলেন ইউনিসেফের প্রতিনিধি অ্যাঞ্জেলিনা। তাঁকে আমাদের কুর্নিশ। |