প্রবন্ধ ১...
আমরা সে ভাবে তাঁকে পড়লামই না
সাদাত হাসান মান্টো-কে উপমহাদেশের দাঙ্গা ও দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কথাকার বললে এত দিনে মনে হয় কেউ আর আপত্তি করবে না। দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার, দাঙ্গার আতঙ্ক, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বিদ্বেষ এত নিপুণ দরদে আর কে-ই বা চিত্রিত করেছেন? দুর্ভাগ্য আমাদের, মান্টোর অধিকাংশ রচনাই উর্দুতে, আর সেকুলার ভারত শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের এই জাতীয় ভাষার চর্চাকে সর্বতোভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। তাই ইংরাজি অনুবাদে, ইংরাজি-শিক্ষিত সাহিত্যপাঠকের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে মান্টো সে ভাবে চর্চিত হলেন না।
পাকিস্তানে যখন ইদের বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্যেই সংখ্যালঘু হিন্দুদের মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়, পরিবারের মেয়েদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে নেয় ক্ষমতাবানরা, ট্রেনে চেপে ভারতে পালানোর সময় জানলা দিয়ে তাদের প্রতিবেশীরা হাত নাড়ে শেষ বার জীবিত দেখতে পাওয়া স্বজনদের উদ্দেশে, মান্টোর কথা মনে পড়ে। তার পাসপোর্ট করাতে না-পারায় তিন দিনের নবজাতককে প্রতিবেশীর কাছে বরাবরের জন্য রেখে দিয়ে এক হিন্দু মা যখন সাশ্রুনয়নে প্রয়াগের কুম্ভ মেলা দেখার পর্যটক-ভিসা নিয়ে রাজস্থান সীমান্ত পেরিয়ে বাকি সন্তানদের বাঁচাতে এ দেশে থেকে যেতে চান, স্বাধীনতা ও দেশভাগের মান্টো-কৃত বিশ্লেষণ বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ভাগলপুরে দাঙ্গায় নিহতদের শব মাটি-চাপা দিয়ে যখন তার উপর কচি-সবুজ ধানের চারা রোপণ করা হয়, ‘জয়শ্রীরাম’ বলতে অস্বীকৃত ইমামের ধড়মুণ্ড আলাদা করে সুরাতে যখন তাঁর আজীবন বোরখাবৃত স্ত্রীকে নগ্ন করে গণধর্ষণ করার চলচ্চিত্র ভিডিও-বন্দি করে যৌথ উপভোগ করা হয়, বা গুজরাতে জীবন্ত সংখ্যালঘু পোড়ানোর সময় ‘হর-হর-মহাদেব’ ধ্বনি ওঠে, সেই পৈশাচিকতাকে পোকায়-কাটা স্বাধীনতায় বিভক্ত উপমহাদেশে বড়ই মান্টো-প্রতিম মনে হয়। হ্যাঁ, সাদাত হাসান মান্টোর— কেবল ‘টোবা টেক সিং’ নয়— আরও অনেক গল্পের মতোই শ্লেষপূর্ণ ও পরিহাসময়।
জালিয়ানওয়ালাবাগের শহর অমৃতসরে মান্টোর জন্ম (১১মে, ১৯১২) ও বড় হওয়া। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিবাদীদের দলে ভিড়তেও রাজনীতিসচেতন এই নবীন কিশোরের সময় লাগেনি। কিন্তু প্রগতি লেখক সংঘের ছকে-বাঁধা সাহিত্য, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতায় আটকে থাকেননি এই কথাকার। সমাজের নিচুতলা অর্থাৎ পানওয়ালা, দোকানদার, ড্রাইভার, ধোপা, দালাল, বেশ্যা ও অসংগঠিত শ্রমজীবীদের পাশাপাশি ওপরতলার গ্লানি ও পাপ, রিরংসা ও নিঃস্বার্থতার মিশ্র জীবনই তাঁকে আকৃষ্ট করে বেশি। তাঁর ‘গন্ধ’ গল্পটিতে যেমন বিত্তবান তরুণ রণধীর এক বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যায় ভিজে-কাপড়ের মজদুরনিকে তার বিলাসবহুল ঘরে আশ্রয় দিয়ে কালক্রমে সম্ভোগে লিপ্ত হয়। এই যৌনতায় সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে তার ঘামে-ভেজা শরীরের দুর্গন্ধ, যা রণধীর নিজের সর্ব শরীর ও চেতনা দিয়ে আকণ্ঠ পান করে। গল্পের শেষে জেলাশাসকের গ্র্যাজুয়েট কন্যার সঙ্গে বাসররাত্রির আসঙ্গেও রণধীর সেই গন্ধের অনুপস্থিতিতে কামার্ত হয়ে উঠতে ব্যর্থ। চল্লিশের দশকের অবিভক্ত ভারতের আইনে মান্টোকে অশ্লীলতার দায়ে তলব করে লাহোরের আদালত।
‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ গল্পে দেখি, দেশভাগের সময়কার দাঙ্গায় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙানো শিখ যুবক ঈশ্বর সিংহ ঘরে ফিরে কিছুতেই প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারছে না। প্রেমিকার সন্দেহ, তার মরদ নিশ্চয় অন্য নারীসঙ্গে মজেছে। ঈর্ষার জ্বালায় ঈশ্বরের কৃপাণ কোষমুক্ত করে সে ক্ষতবিক্ষত করে তাকে। মুমূর্ষু ঈশ্বর স্বীকার করে, সে এক অচেতন মুসলিম বালিকাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারে আসলে সে বালিকাটির শবের সঙ্গে... আখ্যানের তীব্র সংবেদনশীলতা বোঝেনি পাকিস্তান। ‘আমরা মুসলমানরা এতই আত্মমর্যাদারহিত যে আমাদের মৃত কন্যাদেরও শিখরা ধর্ষণ করে যায়?’—এমন প্রশ্ন তুলে লাহোর আদালতে মামলাও ঠুকে দেয় পাক আমলাতন্ত্র।
মান্টো তাঁর সাধের মুম্বই ছেড়ে কেন পাকিস্তানে চলে গেলেন, তা নিয়ে জল্পনা আজও শেষ হয়নি। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত এ শহরেই তাঁর বোহেমিয়ান দিনযাপন, চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে দহরম-মহরম, ফিল্মের চিত্রনাট্য রচনা থেকে পতিত, পাপী-তাপী, মাতাল-বেশ্যাদের ডেরায় ঘুরে বেড়ানো। তবে কেন তিনি ভারত ছাড়লেন? কারণ মুম্বই, বস্তুত সমগ্র উত্তর ভারতই, আর তত দিনে তত সেকুলার নেই, তার ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক শপথের আড়াল থেকে উঁকি মারছে মুসলিমদের একঘরে করার, কাজ না দেওয়ার, ভাতে-পানিতে মারার, হুমকি দিয়ে তাড়ানোর প্রচ্ছন্ন চক্রান্ত। পাকিস্তানে গিয়েও কিন্তু মান্টো লিখছেন ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’র মতো গল্প, যাতে প্রতিবেশী হিন্দু বালিকা শারদার প্রেমে পড়া মুসলিম কিশোর মুখ্তার ‘প্রেমের ধর্মের কাছে আর সব ধর্মই তুচ্ছ’ ঘোষণা করেও বিয়ের জন্য প্রেমিকাকে ইসলাম গ্রহণে চাপ দেয়। শারদা যখন পাল্টা তাকে হিন্দু হতে বলে, তখনই মুখ্তার ইসলামের উৎকর্ষ আর পৌত্তলিক ও গোময়পায়ী হিন্দুত্বের অপকর্ষ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ‘বুকের মধ্যে ইসলাম গুঁজে নিয়ে’ শারদার বন্ধ দরজা থেকে ফিরে আসে। কিংবা মনে করুন আর এক হাড়-হিম-করা গল্প ‘ফিরে আসা’, যাতে দাঙ্গায় স্ত্রী-হারানো সিরাজুদ্দিন পরমাসুন্দরী কন্যা সাকিনাকে উদ্ধার করতে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ করেন। কিছু দিন পর স্ট্রেচারে-শোয়া অচেতন মেয়েকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে দেখে ফিরে-পাওয়ার আনন্দে সিরাজুদ্দিন পিছু-পিছু ঢোকেন। ডাক্তার তাঁকে ঘরে আলো আসার জানলা দেখিয়ে বলেন, ‘খুলে দাও’। অর্ধচেতন সাকিনা তৎক্ষণাৎ নিজের সালোয়ারের দড়ি আল্গা করে নামিয়ে দু’পা ফাঁক করে দেয়। এত অসংখ্য বার সে বিধর্মী হিন্দু ও স্বধর্মী মুসলিমদের দ্বারা ধর্ষিত, যে ‘খুলে দাও’ উচ্চারণে সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় তার হাত সালোয়ারের দড়িতে চলে যায়।
এমন গল্পকারকে পাকিস্তানই বা কী করে হজম করবে? ১৯৫০ সালে মান্টো স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রুপে লেখেন, ‘এক দিন হয়তো পাকিস্তানের সরকার আমার কফিনে একটা মেডেলও পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।’ পাকিস্তানের জন্মের ৬৫ বছর উপলক্ষে গত অগস্টে পাক সরকার ঠিক সেটাই করেছে। সাদাত হাসান মান্টোকে তারা ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছে, যিনি তাঁর ‘এপিটাফ’-এ লিখে গিয়েছিলেন, ‘এই সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই ছোটগল্পকার, যে ভাবছে, খোদা, নাকি সে নিজে, কে বেশি ভাল গল্পকার!’ মৌলবাদীদের হামলার ভয়ে মান্টোর পরিবার তাঁর সমাধিতে এটা খোদাই করার সাহস পায়নি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.