কলিকাতাকে লালবাতির শহর বলা যায়। যত্রতত্র লালবাতি লাগানো অসংখ্য গাড়ি নিত্যদিন মহানগরীকে সচকিত করিয়া অন্যান্য যানবাহন, পথচারীদের ত্রস্ত, ব্যস্ত, বিচলিত করিয়া দাপাইয়া বেড়ায়। যত দিন যাইতেছে, ততই লালবাতি লাগানো গাড়ির সংখ্যা ও তাহাদের উৎপাতের পরিমাণ জ্যামিতিক প্রগতির হারে বাড়িতেছে। বিপুলসংখ্যক বিশিষ্ট জন এ শহরে লালবাতির বিশেষাধিকার ভোগ করেন। উপরন্তু কত লালবাতি লাগানো গাড়ি ওই বাতি লাগাইবার সম্পূর্ণ অনধিকারী, তাহার হিসাবও কেহ রাখে বলিয়া মনে হয় না। সরকার লালবাতির অধিকারীদের কোনও তালিকা প্রস্তুত করে নাই, পুলিশও অনধিকারীদের বাতি খুলিয়া ফেলিতে বাধ্য করার উদ্যোগ লয় নাই। আদালত তাই এ বার পুলিশের হাতে ফৌজদারি আইনের হাতিয়ার তুলিয়া দিয়াছে, যাহা প্রয়োগ করিয়া ইচ্ছা করিলে পুলিশ লালবাতির স্বৈরাচার হইতে মহানগরীকে মুক্ত করিতে পারে।
এই সদিচ্ছা আসলে যানশাসনেরই সদিচ্ছা। কিন্তু অনুমান করা যায়, ইহা প্রবল হইতে পারে না ভিআইপিদের রক্তচক্ষু এবং তাহা অগ্রাহ্য করিতে সাহসী ট্রাফিক পুলিশের বদলি হওয়ার ভয়ে। এত কাল পুলিশের হাতে কোনও ফৌজদারি আইন ছিল না। ফলে কর্তাব্যক্তিরা নকল ভিআইপিদের গাড়ি হইতে লালবাতি খুলিয়া ফেলার অপারগতার সাফাই গাহিতে গিয়া আইনগত সমস্যার অজুহাত দিতেন। কলিকাতা হাইকোর্ট অতঃপর সেই রাস্তাও আর খোলা রাখিল না। এই বিধিভঙ্গের দায়ে অতঃপর তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হইতে পারে। অর্থাৎ পুলিশ, বিশেষত ট্রাফিক পুলিশ যদি লালবাতির অনাচার হইতে মহানগরীর রাজপথকে মুক্ত করিতে বাস্তবিকই আগ্রহী হয়, তবে তাহার সামনে ইহাই শেষ সুযোগ।
প্রশ্ন হইল, নূতন আইনগত রক্ষাকবচ কি নাগরিকদের একটু স্বস্তিতে রাস্তায়-ঘাটে চলাফেরার সুযোগ করিয়া দিবে? অনধিকারী হইয়াও যে ব্যক্তি নিজের গাড়িতে লালবাতি লাগায়, সে তো আইনের শাসনকে অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা দেখাইতেই অভ্যস্ত। পুলিশ কি ফৌজদারি আইনে সজ্জিত হওয়ার বলে বলীয়ান ও সাহসী হইয়া উঠিতে পারিবে? বোধহয় পুলিশের পক্ষে কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ হইত, যদি রাজ্যের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ হইতে এ ব্যাপারে তাহাকে অভয় দেওয়া হইত। মনে রাখা দরকার, স্বরাষ্ট্র দফতর আদালতের পৌনঃপুনিক আর্জি সত্ত্বেও অদ্যাবধি লালবাতি ও ভেঁপুর অধিকারী রাজ্যের বিশিষ্ট প্রশাসনিক আধিকারিকদের তালিকা প্রকাশ করে নাই। এই অস্পষ্টতা যে ইচ্ছাকৃত নয়, তাহার প্রমাণ কী? এক দিকে নিজেকে আকবর বাদশাহ অর্থাৎ ভিআইপি গণ্য করিয়া শ্লাঘা বোধ করার প্রবণতা, অন্য দিকে সরকারের তরফেও বিশিষ্টতার সংজ্ঞা নির্ণয়ে অস্পষ্টতা কলিকাতার পথঘাটকে ভিআইপি-উপদ্রুত করিয়াছে। আইনি অস্ত্রে বলীয়ান হইয়া পুলিশ সেই উপদ্রব কতটা হ্রাস করিতে পারে, ভবিষ্যৎই বলিয়া দিবে। |