খাঁচার পাখির বৈশিষ্ট্য হইল, যাহার কাছে খাঁচা, পাখি তাহারই সম্পত্তি বনিয়া যায়, তাহাকেই কর্তা মানে। সম্প্রতি সর্বোচ্চ জাতীয় আদালত সি বি আই সম্পর্কে যে ‘খাঁচার-পাখি’ ঘোষণা করিয়াছে, তাহাতেই পরিস্ফুট পাখির সম্পূর্ণ হস্তান্তরযোগ্য বিশ্বস্ততা। এ দেশে যে কোনও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, এমনকী সি বি আই নিজেও এই খাঁচার পাখি-সুলভ গুণটিতে মণ্ডিত। এবং যে কোনও প্রশাসন, পাখির কর্তার ভূমিকায় তাহাকে বুলি শিখাইতে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ও সংশ্লিষ্ট নেতৃবর্গের কত জন যে কয়লা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত, ইয়ত্তা পাওয়া কঠিন। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ, তিনি নিজের দায় যথাযথ ভাবে পালন করেন নাই। কিন্তু যাহারা এই কেলেংকারি লইয়া হইচই করিতেছে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ-দাবি তুলিতেছে, আন্দোলন কর্মসূচি বানাইতেছে, সেই বি জে পি-ই কি এই দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্ক-রহিত? ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিংহের বিরুদ্ধে কয়লাখনি-দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চহ্বাণও তুলসীপাতা নহেন। নরেন্দ্র মোদীর পিঠ-চাপড়ানি ব্যতীত আত্মরক্ষার কোনও অস্ত্রই তাঁহাদের হাতে নাই। অর্থাৎ বি জে পি নেতাদের নৈতিক স্খলনও বড়ই প্রকট, বিশেষত যেখানে তাঁহারা ক্ষমতাসীন। বিভিন্ন তদন্তকারী পক্ষকে খাঁচার পাখির বুলি শিখাইয়া তাঁহারা আত্মরক্ষা করিতেছেন। এক সুরসিক লেখক লিখিয়াছিলেন, কাচের ঘরে বাস করিলে প্রবল বেগে নিরন্তর অন্যের প্রতি ঢিল ছুড়িতে হয়।
কেবল কংগ্রেস বা বি জে পি নহে। কেন্দ্রে, রাজ্যে, সর্বত্র ভারতের রাজনীতি মানচিত্রে দুর্নীতির এই সর্বব্যাপিতা। এবং লোকমান্যতা। কার্যত প্রতিটি দলই নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতৃবর্গ তৈরি করে, তাঁহারা ক্ষমতাসীন হইলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। প্রধানত দুই পথে অপব্যবহার চলে। এক, স্বজন-বৃত্তের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তির ব্যবস্থা, এবং দুই, অতিরিক্ত অর্থ-উপার্জনের অনৈতিক বন্দোবস্ত। কাহারও ক্ষেত্রে সরাসরি ব্যক্তিগত সিদ্ধি, কাহারও ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত কিংবা পার্টিগত সিদ্ধি। কিন্তু পন্থা ও পদ্ধতির মধ্যে আশ্চর্য সমতা লক্ষণীয়: দেশের আইনব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া সংকীর্ণ স্বার্থের পোষণ। তদন্তের রাডারে ক্বচিৎ ধরা পড়িলে ইহার নাম দুর্নীতি; কিন্তু ধরা না পড়িলে ইহাই প্রাত্যহিক ও সার্বিক দস্তুর, তখন তাহার নাম ভারতীয় রাজনীতি।
যে দুর্নীতি এমন সর্বস্বীকৃত, স্বাভাবিক ভাবেই সেই দুর্নীতি সর্বঘৃণিত হইতে পারে না। এই দোষ সকলেরই, তাই সকলেই এই দোষ বিষয়ে নিরুত্তাপ, নিস্পৃহ, নিষ্ক্রিয়। তাই এ দেশের রাজনৈতিক সংবাদের আগাপাস্তলা দুর্নীতি-সংক্রান্ত শিরোনামে ধ্বস্ত হইলেও প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি কোনও সংবাদই নহে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইহার তেমন বৈচারিক পরিণাম নাই। কোনও রাজনৈতিক ফলাফলও নাই। কোনও সরকার কেবল শাসন-সংক্রান্ত দুর্নীতির জন্য এ দেশে শাস্তি পায় না। দুর্নীতির সঙ্গে প্রশাসনিক স্খলন বা অকর্মণ্যতা যুক্ত হইলে শাস্তি মিলিতেও পারে, কিন্তু সেখানেও প্রশাসনিক ব্যর্থতাই মুখ্য বিষয়, দুর্নীতি গৌণ। সম্প্রতি কর্নাটকে ইহারই স্পষ্ট উদাহরণ দেখা গেল। কংগ্রেসের তরফে বড় গলায় ঘোষণা হইল যে ইয়েদুরাপ্পার দুর্নীতিই বি জে পি নির্বাচনী-তরী ডুবিবার কারণ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বি জে পি-র পরাজয় ঘটাইল ভোট ভাগাভাগির হিসাব, তাহার জনসমর্থন-হ্রাস নয়। দুর্নীতিই যদি জনসমর্থন কমাইত, তবে ইয়েদুরাপ্পা স্বয়ং ও তাঁহার নবজাত দল এত পরিমাণ ভোট পাইতেন না। একই ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের দুই-দুই জন মন্ত্রী পদত্যাগ করিবার পর ইউ পি এ-র নির্বাচনী পরাজয় ঘটিলেও প্রশ্ন থাকিয়াই যাইবে, এই পরাজয় কি সত্যই দুর্নীতি-প্রসূত, না কি পাঁচ বৎসর-ব্যাপী চূড়ান্ত অকর্মণ্যতার ফলাফল? দুর্নীতির প্রতি এই ব্যাপ্ত নিস্পৃহতা ভারতের গণতন্ত্রের শক্তি না দুর্বলতা, কীসের চিহ্ন কে বলিবে! হয়তো ভারতীয় জনসাধারণ দুর্নীতির বাস্তবতার সহিত নিজেদের মানাইয়া লইয়াছেন। হয়তো তাঁহাদের সম্মুখে যথার্থ দুর্নীতিমুক্ত কোনও চয়নের সুযোগ নাই। কথাটি অযৌক্তিক নহে, কিন্তু এই বাস্তব ভারতীয় গণতন্ত্রের মুখ উজ্জ্বল করে না নিশ্চয়ই। |