ছেলের জন্মদিনে কেক কাটা নয়, বরং তার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে মেনে বাড়িতেই রক্তদান শিবিরের আয়োজন করলেন মা। রক্ত দিলেন পড়শি ও আত্মীয়স্বজনেরা। রবিবার বিকেলে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে এ ভাবেই তাঁর একমাত্র সন্তান সৌরভ হাসানের জন্মদিন পালন করলেন ডিওয়াইএফের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর প্রাক্তন সদস্য হানুফা বানু। রক্ত দিলেন ৩৬ জন।
রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা উদ্যোগকে উৎসাহব্যাঞ্জক বলছেন। রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দীপঙ্কর মিত্রের মতে, “১৮ বছরের জন্মদিনে নিজে কোনও ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে রক্তদান করে আসার নজির আমরা দেখেছি। কিন্তু, এ ভাবে নিজের বাড়িতে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। এতে অনেকেই উৎসাহ পাবেন।”
চিকিৎসকদের একাংশ অবশ্য বাড়িতে রক্তদান শিবির করা কতটা বিজ্ঞানসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ভাবে রক্ত নিলে অনেক ক্ষেত্রেই বিপত্তির আশঙ্কা থেকে যায় বলেও তাঁরা জানিয়েছেন। সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা সৌরেন্দ্রনাথ গুছাইতের বক্তব্য, “বাড়িতে এমন শিবিরের আয়োজন আমরা কোনও ভাবেই উৎসাহিত করি না। নিয়ম হল, কোনও রেজিস্টার্ড সংগঠন দু’মাস আগে তাদের লেটারহেডে কোনও ব্লাড ব্যাঙ্কের কাছে শিবিরের আবেদন জানাবে। সেই ব্যাঙ্ক নিয়ম মেনে সব হচ্ছে মনে করলে তবেই অনুমতি দেবে। রক্তদান শিবির আর যা-ই হোক, ঝোঁকের মাথায় করা যায় না।” |
সৌরভের জন্মদিনে তাঁর বাড়িতে রক্ত সংগ্রহে গিয়েছিলেন তাঁদের রক্ত ভরছিলেন বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা। হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার সুব্রত বিশ্বাস বলছেন, “ব্লাড ব্যাঙ্ক রক্তশূন্য হলে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রক্তদান শিবিরের কোনও বাধা নেই। এ ক্ষেত্রে ব্লাড ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার রয়েছে। এখানে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ৩৬ জনের রক্ত নিয়েছি। এখন গরমে রক্তের সঙ্কটের মুর্হূতে এই উদ্যোগ স্বাগত।”
রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মানুষজন এ-ও বলছেন, “এমন কিছু লোক আছেন, হয়তো তাঁদের সংখ্যাটা কম, যাঁরা প্রতিবছর নির্দিষ্ট দিনে (মা-বাবার মৃত্যু দিবস বা এমন কোনও উপলক্ষে) ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে রক্ত দেন। এ দেশে, যেখানে রক্তদান নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি এখনও কাজ করে এবং রক্ত সঙ্কট তীব্র, সেখানে এ ধরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগের গুরুত্ব অপরিসীম। অতীতে বিয়ে বাড়িতেও রক্তদান শিবিরের নজির রয়েছে।”
বিষ্ণুপুর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সোনামুখীমোড়ে হানুফার বাড়িতে এ দিন বিকেলে ছিল গিজগিজে ভিড়। ভিতরে ছোট ছোট ক্যাম্প খাটে শুয়ে রক্ত দিচ্ছিলেন হানুফার আত্মীয়েরা। হানুফার কথায়, “ছোট থেকেই সৌরভ আমার সঙ্গে সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যেত। রক্তদান শিবিরে গেলেই ও রক্ত দেওয়ার জন্য বায়না ধরত। ওকে বোঝাতাম ১৮ পেরোলেই রক্ত দিতে পারবে।” বিষ্ণুপুরের রামানন্দ কলেজের ছাত্র সৌরভ এ দিন আঠারোয় পা দিলেন। হানুফা বলেন, “এ বার ওর ইচ্ছে পূরণ করতেই ঠিক করি বাড়িতে রক্তদান শিবির করে ওকে জন্মদিনের উপহার দেব।”
মায়ের উপহার পেয়ে খুশি সৌরভও। তিনি জানান, বছর খানেক আগে রক্তের অভাবেই তাঁর এক বন্ধু মারা যান। তখন থেকেই রক্ত দেওয়ার তাগিদ আরও তীব্র হয়। এ দিন তাঁর আক্ষেপ মিটেছে। প্রথম রক্ত দেন সৌরভই। পাশের বিছানায় রক্ত দেন মা হানুফা ও কাকিমা রেহেনা। জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পেয়ে রক্ত দিয়ে যান পড়শি মঞ্জু সালুই, বনানি সালুই, পিউ মল্লিকঠাকুর। সৌরভের বন্ধু খাইরুল মীর, সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গেই রক্ত দেন হানুফার বন্ধু শুভ্রা মল্লিক, বিশ্বজিৎ ঘোষরা। ছিলেন ডিওয়াইএফের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক তাপস সিংহ।
রক্তদানেই অবশ্য শেষ হয়ে যায়নি অনুষ্ঠান। অতিথিদের জন্য ছিল ভোজ ও মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা। |