শ্রীসন্তের ছোড়া এক-একটা বল মাঠের বাইরে গিয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে ওঠানামা করছে জুয়ার দরও। আগের বলে একশো টাকার বাজিতে মিলছিল পাঁচশো টাকা! পরের বলেই একশো টাকা লাগিয়ে হাজার টাকার হাতছানি! মুহূর্তের মধ্যে ক্রিকেট জুয়ার এই হিসেবনিকেশ কষে দিচ্ছে ‘ব্যাক এন লে প্রো’। এই সফ্টওয়্যারের মাধ্যমেই আইপিএল-এর প্রতিটি ম্যাচে, প্রতিটি বলে চলছে জুয়ার দরের ওঠানামা এবং লাভ-ক্ষতির হিসেবনিকেশ।
২০১১-র ক্রিকেট বিশ্বকাপ থেকে ২০১৩-র আইপিএল সিক্স! ক্রিকেট জুয়া যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ‘ব্যাক এন লে প্রো’। মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের বিশ্বকাপ জয়ের বছরেই এই সফ্টওয়্যারটির সন্ধান পেয়েছিল পুলিশ। তখনই জানা গিয়েছিল, এই সফটওয়্যারের মাধ্যমেই চুটিয়ে ক্রিকেট জুয়া চলছে। দু’বছর পরে দেখা যাচ্ছে, এই সফ্টওয়্যারের হাত ধরেই ক্রিকেট জুয়া আরও ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু দিল্লি নয়, মুম্বই, কলকাতা, হায়দরাবাদ, চেন্নাই দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তেই ক্রিকেট জুয়ারিরা এই সফটওয়্যারটিকেই কাজে লাগাচ্ছে। এই প্রযুক্তির হাত ধরে ক্রিকেট জুয়ায় মূলত দু’টি বদল এসেছে। প্রথমত, পুরো ম্যাচের উপর বাজি ধরার প্রবণতা কমেছে। ম্যাচের প্রতিটি ওভার, এমনকী প্রতিটি বলের জন্যও বাজি ধরা হচ্ছে। ব্যবহার কমেছে টেলিফোনের। তার বদলে ইন্টারনেটে ই-মেলের মাধ্যমে বাজি লাগানোর প্রবণতা বেড়েছে। কারণ ‘ব্যাক এন লে প্রো’ প্রযুক্তির সাহায্যে খদ্দেরকে অত্যন্ত দ্রুত জুয়ার দর জানিয়ে দিতে পারছেন বুকিরা। খদ্দেররাও লাভক্ষতির অঙ্ক হিসেব করে বাজি লাগাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, লাভক্ষতির অঙ্ক সহজেই কষে ফেলা সম্ভব হওয়ায় অনেক কম টাকা হাতে নিয়েও জুয়ায় বাজি ধরা সম্ভব হচ্ছে।
শ্রীসন্তদের গ্রেফতারের পর এখন দেশের বড় শহরগুলিতে হানা দিচ্ছেন দিল্লি পুলিশের অফিসাররা। তদন্তকারীদের বক্তব্য, আগে মূলত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোকেরাই ক্রিকেটে বাজি ধরতেন। কারণ বাজি লাগানোর জন্য ন্যূনতম টাকার অঙ্কটা যথেষ্ট বেশি ছিল। কিন্তু এখন নতুন সফ্টওয়্যার ব্যবহারের ফলে যে হেতু লাভ-ক্ষতির অঙ্ক খুব সহজেই বোঝা যায়, তাই ন্যূনতম বাজির দরও দু’তিন হাজার টাকায় নেমে এসেছে। তাই মধ্যবিত্ত এমনকী চাকুরিজীবীরাও এখন ক্রিকেট জুয়ায় টাকা লাগাচ্ছেন। দিল্লি ও মুম্বইয়ের মতো বড় শহরগুলিতে স্কুল-কলেজের ছাত্ররাও হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে জুয়ার বাজি লাগাচ্ছে! উঠতি ক্রিকেটাররাও অনেকে এর টানে জড়িয়ে পড়ছেন বলে পুলিশের বক্তব্য। ছোট ছোট সিগারেটের দোকান, সাইবার কাফের মাধ্যমে জুয়ার খোঁজখবর পৌঁছে দেওয়া হয় উঠতি বয়সের ছেলেদের কাছে।
ক্রিকেট জুয়ার সঙ্গে পরিচিত পুলিশ-কর্তাদের বক্তব্য, আগে বুকিরা জুয়ার হিসেব কষার জন্য নোটবুক ব্যবহার করত। খদ্দের বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিসেবের অঙ্কও বাড়ত। ফলে ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেও বহুক্ষণ পর্যন্ত এই হিসেবনিকেশ চলত। এখন বুকিরা যে সব কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ব্যবহার করেন, সবগুলিতেই এই ‘ব্যাক এন লে প্রো’ সফ্টওয়্যার মেলে। ইন্টারনেট থেকে নিখরচায় ডাউনলোড করে নেন তাঁরা। যাঁরা বাজি ধরেন বা খদ্দেরের নাম, মোবাইল নম্বর এবং কত টাকার বাজি লাগাচ্ছেন, তা সফ্টওয়্যারে দিয়ে দেওয়া হয়। ম্যাচের শেষে নিজে থেকেই এই সফ্টওয়্যার বলে দেয়, কারা কত টাকা জিতেছেন, কারা কত টাকা হারিয়েছেন।
আইপিএল গড়াপেটা কাণ্ডে ধৃত বুকিদেরও জেরা করছেন তদন্তকারী অফিসাররা। তাঁদের বক্তব্য, বুকিরা এক সঙ্গে অসংখ্য মোবাইল ব্যবহার করেন। বড় বুকিদের কাছে প্রায় শ’খানেক মোবাইল থাকে। ম্যাচের আগে প্রাথমিক ভাবে জুয়ার দর ঠিক করে দেওয়া হয় দুবাই থেকে। তার পরে প্রতিটি ওভারের প্রতিটি বলের সঙ্গে জুয়ার দর ওঠানামা করতে থাকে। সেগুলিও দুবাই থেকেই ঠিক করে দেওয়া হয়। জুয়ার দর কত চলছে, তা জানার জন্য আলাদা একটি মোবাইল থাকে। বুকিদের ভাষায় যার নাম ‘ডাব্বা’। যে ঘর থেকে ক্রিকেট জুয়ার কারবার চলে, সেখানে এই মোবাইলের সঙ্গে একটি লাউডস্পিকার বা অ্যামপ্লিফায়ার লাগানো থাকে। তা শুনেই বাকিরা মোবাইলে খদ্দেরদের জানাতে থাকেন, কত টাকার বাজি লাগিয়ে কত টাকা মিলছে। বাজির দর শুনে ‘ব্যাক এন লে প্রো’ প্রযুক্তির সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে লাভক্ষতির অঙ্ক কষে খদ্দেরদের জানিয়ে দেন বুকিরা। দিল্লি পুলিশ কর্তাদের হিসেব অনুযায়ী, শুধু রাজধানী ও তার সংলগ্ন এলাকাতেই আইপিএলের ম্যাচ পিছু অন্তত পাঁচ কোটি টাকার বাজি লাগানো হয়। |